সোনা চোরাচালানিদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন কর্মকর্তার যোগাযোগ রয়েছে। চোরাই সোনা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চোরাচালানিরা ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন। সোনা উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর এক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য জানিয়েছেন। আদালত সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা হলেন রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) এস এম শিবলী নোমান। যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি সোনা চোরাচালানিদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করিনি। তা ছাড়া, যে এলাকায় সোনা ধরা পড়েছে, সেটা আমার এলাকাও নয়।’
গত ১৩ মার্চ রামপুরা থানার পুলিশ ২৩৫টি সোনার বারসহ একটি কার আটক করে। এরপর ১৬৫টি বার আত্মসাৎ করে অন্যগুলো উদ্ধার দেখানো হয়। এ ঘটনা জানাজানির পর রামপুরা থানার তিন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। থানার ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালাকে প্রত্যাহার করা হয়। অভিযোগ ওঠে, সোনা চোরাচালানিদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এ ঘটনা তদন্ত করছে।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, সোনা আত্মসাতের ঘটনায় চার পুলিশের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা। তাঁরা হলেন ওসি কৃপা সিন্ধু বালা, উপপরিদর্শক (এসআই) মঞ্জুরুল ইসলাম, কনস্টেবল আকাশ চৌধুরী ও ওয়াহেদুল ইসলাম। ওসি ছাড়া অন্য তিনজন এখন কারাবন্দী।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ১৩ মার্চ পুলিশ সদস্যরা গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ২৩৫টি সোনার বার পেলেও ১৬৫টি ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। বিষয়টি তিন দিন গোপন রাখার পর ১৬ মার্চ কারের সিটে ৭০টি সোনার বার লুকিয়ে রেখে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তা উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এর আগে ধরা পড়া চোরাচালানির সঙ্গে যুক্ত মাহিন ও সমীর সব তথ্য ফাঁস করে দেন। তাঁরা জানান, গাড়িতে ২৩৫টি সোনার বার ছিল।
তাঁদের কথার সূত্র ধরে ডিবির একাধিক দল তদন্তে নামে। গাড়ির জব্দ তালিকায় সাক্ষীদের ডিবি কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদে কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন যে গাড়ির ভেতর থেকে সোনার বার খোয়া গেছে। পুলিশ সোনা চোরাচালানির ঘটনায় জাহেদ হোসেন ওরফে মাহিন ও গাড়িচালক সমীর কুমার বিশ্বাসকে আটক করে তাঁদের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে। ডিবি পুলিশের সোর্স রনি, তিন পুলিশ মঞ্জুরুল, আকাশ ও ওয়াহেদুলের স্বজনদের বাসা থেকে ১৪৯টি বার উদ্ধার করা হয়। জাহেদ ও সমীর এ ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
আদালত সূত্র জানায়, জাহেদ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, গত ১৩ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে তিনি এবং চোরাচালান চক্রের মূল হোতা অনীক চট্টগ্রাম থেকে প্রাইভেট কারে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। গাড়িতে অনীক একটা কালো ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ‘ব্যাগে স্বর্ণের বার আছে, ব্যাগটা ঢাকায় পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের কাজ শেষ।’
জবানবন্দিতে জাহেদ আরও বলেন, ঢাকায় পৌঁছে অনীক ও তিনি বনশ্রী এলাকার একটি বাসায় ওঠেন। সেখানে তিনি ব্যাগ খুলে গণনা করে দেখতে পান ২৩৫টি স্বর্ণের বার আছে। রাত নয়টার দিকে তিনি ও অনীক স্বর্ণের বারগুলো নিয়ে সমীরের গাড়িতে তাঁতীবাজারের উদ্দেশে রওনা করেন। বনশ্রী ই ব্লকে পুলিশের একটি মাইক্রোবাস তাঁদের বহনকারী গাড়িকে পেছন থেকে অনুসরণ করতে থাকে। রাত ১০টার দিকে রাস্তা খুঁজে না পেয়ে বনশ্রী বালুরমাঠ এলাকায় গাড়ি ফেলে পালিয়ে যান তাঁরা। এক ঘণ্টা পর বনশ্রী ই-ব্লকের বাসায় ফেরেন।
জাহেদ আদালতকে বলেন, ১৫ মার্চ অনীক তাঁকে একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে ওই নম্বরে ফোন করতে বলেন। ফোন করলে তাঁকে ঢাকা ক্লাবে যেতে বলা হয়। সেখানে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সমীরের দেখা হয়। যাকে ফোন করেছিলেন তিনি তাঁকে ও সমীরকে ভেতরে নিয়ে যান। ভেতরে থাকা পাঁচজন বলেন, তাঁরা তাঁদের অপেক্ষায় আছেন। এরপর তাঁরা রামপুরা থানার ওসির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। এরপর সমীর ও তিনি বাইরে এসে দাঁড়ান। রাত ১২টার দিকে তাঁকে ফোন দিয়ে আবার ক্লারেব ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওনাকে চিনো? ওনি শিবলী নোমান, পুলিশ অফিসার।’
জাহেদ জানান, এরপর তাঁরা ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ঘটনা খুলে বলেন। ১৬ মার্চ অনীক ফোন দিয়ে ঢাকা ক্লাবের সামনে যেতে বলে। রাত আটটায় সেখানে গেলে যান গেটে সমীরের সঙ্গে দেখা হয়। ঢাকা ক্লাবে থাকা পাঁচজন লোক তাঁদের রামপুরা থানায় নিয়ে যান।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এসি শিবলী নোমানের যোগাযোগ রয়েছে, এমন অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হয়তো শিবলী নোমান কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপে রামপুরা থানায় আটক সোনা চারাচালানিদের কারটি ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেন, সোনা আত্মসাতের সঙ্গে রামপুরা থানার ওসির জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। চোরাচালানটি গাবতলীর একজন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, ৩১ মার্চ কথিত পুলিশ সোর্স রনিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁর কাছ থেকে ১৪টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। এরপর পুলিশের তিন সদস্যকে ডিবিতে এনে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁরা সোনা ভাগ-বাঁটোয়ারার কথা স্বীকার করেন। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিন গভীর রাতে ডিবি পুলিশের একাধিক দল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অভিযান চালিয়ে এসআই মঞ্জুরুলের হবু শ্বশুরবাড়ির ফ্রিজ থেকে ৫৮টি বার, কনস্টেবল আকাশের গাজীপুরের শ্বশুরবাড়ি থেকে ১৪ এবং বগুড়ার সোনাতলায় ওয়াহেদের গ্রামের বাড়ি থেকে ৬৩টি সোনার বার উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ডিবির ওই কর্মকর্তা জানান, চোরাচালানিরা আটক সোনা ও গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে এক কোটি ১০ লাখ টাকা নিয়ে দুই দিন থানায় ঘোরাফেরা করেছিলেন বলে তদন্তে জানা গেছে। সোনা চোরাচালানির সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। এ ঘটনায় পুলিশ সোর্স রনির স্ত্রী ও গাড়িচালক সমীরের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। চক্রের মূল হোতা অনীককেও ধরার চেষ্টা চলছে।
মামলা হয়নি: ৩১ মার্চ সোনা আত্মসাতের ঘটনায় রামপুরা থানার তিন পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হন। এর সাত দিন পরও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।
কেন হয়নি? জানতে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আত্মসাতের (৪০৯ ধারা) ঘটনায় থানায় মামলা করতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুমতি নিতে হয়। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দুদকের কাছে লিখিত অনুমতিও চাওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে অনুমতি না মেলায় তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা যায়নি।
গত বছর রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৬৪টি চালানে ২৭২ কেজি সোনা উদ্ধার হয়। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৪৯টি চালানে ১৯১ দশমিক ২৯০ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে।