একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। সাংবাদিক পেটানো, প্রকৌশলীকে চড়-থাপ্পড়, প্রকাশ্যে ঘুষ দাবি, সোনার নৌকা উপহার নেয়া, সংবর্ধনার নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা, একে-অপরকে সরাসরি আক্রমণসহ নানা আচরণের জন্য সমালোচিত হচ্ছেন তারা। সিনিয়র মন্ত্রী থেকে শুরু করে একেবারেই নবীন এমপিরাও বাদ যাচ্ছেন না এসব কাজ থেকে। শুধু দশম সংসদই নয়, এর আগের সংসদের অনেক প্রভাবশলী মন্ত্রী-এমপিও একইভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এতে নানা সময় বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়েছে সরকারকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এবার সরকার গঠনের পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই কোনো ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে না জড়াতে মন্ত্রী-এমপিদের সতর্ক করে দেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপক্ষো করে সরকারের মন্ত্রী, সংসদের হুইপ এবং দলীয় এমপিরা একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে চলেছেন। তাদের অপকর্মে এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকার সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। আর সরকারও খানিকটা বেকায়দায় পড়েছে।
এবার মন্ত্রিসভা গঠনের পরই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সোনার নৌকা উপহার নিয়ে ব্যাপক হই চই ফেলে দেন রাজশাহীর এমপি ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। পরে নানা সমালোচনার মুখে তিনি ওই নোকা একটি এতিমখানায় দান করার ঘোষণা দিয়ে আপাতত নিষ্কৃতি পান।
এর পরই সংসদে চিফ হুইপের দায়িত্ব পেয়ে আ স ম ফিরোজ নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ঘুষ দাবি করে বলেন, ‘ক্রেস্ট চাই না, এবার ক্যাশ চাই, ক্যাশ।’ তার এ ঘোষণায় রীতিমতো নির্বাক বনে যান উপস্থিত নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। এর আগেও একাধিকবার হুইপের দায়িত্বপালনকারী এ রাজনীতিকের ওই বক্তব্যে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে সরকার।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহসীন আলী সিলেটে বিজিবি স্কুলে শিার্থীদের এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে বসে প্রকাশ্যে ধূমপান করে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার সেই ছবি প্রকাশিত হলে বিপাকে পড়ে সরকার। একপর্যায়ে সেই আচরণের জন্য মা প্রার্থনা করেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। তবে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না এ মন্ত্রীর। গত মাসের প্রথম দিকে ভারত সফরে যান তিনি। তার সফরসঙ্গী ছিলেন তিনজন। তবে সঙ্গী তিনজনের কারো পাসপোর্ট ছিল না। মন্ত্রিত্বের জোরে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন তাদের ছেড়ে দিলেও ভারতীয় ইমিগ্রেশন তাদের আটকে দেয়। মন্ত্রীকে ছাড়া মন্ত্রীর তিন সঙ্গীকে ফেরত পাঠায় আসাম। এ নিয়ে আসামের একটি দৈনিক পত্রিকা ফলাও করে রিপোর্ট প্রকাশ করলে আবারো আলোচনায় আসেন তিনি। এর আগে মন্ত্রিত্ব পেয়ে শুরুতেই গণমাধ্যমে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘হু ইজ বিএনপি। হোয়াই নট দে কাম টু দি ইলেকশন’ মন্তব্য করে নজর কাড়েন তিনি।
নানা সময়ে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে রাজনীতিতে বহুল আলোচিত সরকারের ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী গত ২৮ মার্চ নিজ বাড়িতে ডেকে নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন উপসহকারী প্রকৌশলীকে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করেন। এর বিচার দাবিতে আন্দোলনে নামেন প্রকৌশলীরা। সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর এমন আচরণে সাধারণ মানুষও ুব্ধ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ সম্প্রতি নিজ উপজেলা শিা অফিসারের কে এমরান ফারুক নামে এক সাংবাদিককে ব্যাপক মারধর করেন। সাংবাদিক পেটানোর কথা অকপটে স্বীকারও করেছেন সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ। এ ঘটনার প্রতিবাদে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাংবাদিকেরা ওই এমপিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার সব ধরনের সংবাদ বর্জনের ঘোষণা দেন। পরে তিনি গণমাধ্যমকে দেয়া এক বক্তব্যে বলেন, এমরান ফারুককে তিনি সাংবাদিক হিসেবে পেটাননি বরং এমরান তাদের দলীয় সদস্য। বিষয়টি দলীয় ফোরামে সুরাহা হবে। ঘটনার সাথে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক নেই।
সর্বশেষ প্রকাশ্যে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল (লোটাস কামাল)। তাদের এ প্রকাশ্য বিরোধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের নানা মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। গত সোমবার পরিকল্পনা কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তার কক্ষে সংশোধিত এডিপি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর দেয়া চিঠির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি (অর্থমন্ত্রী) আমাকে অনুধাবন করতে বলেছেন। আমিতো ওনার সহকর্মী, অধীন নয়। উনি প্রতি বছর বিশাল বাজেট দেন। হাজার হাজার কথা বলেন। কিন্তু অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেন না। বাজেট বক্তব্য দিতে দিতে উনি শুয়ে পড়েন। আমি হলে ১৫ পাতায় বাজেট শেষ করে দিতাম। তবে এটা ঠিক যে ওনার বয়স হয়েছে। অনেক কিছু ভুল-ভাল বলেন। আমরা মাফ করে দেই।’
পরিকল্পনা মন্ত্রীর এমন তীর্যক মন্তব্যের পর মঙ্গলবার সচিবালয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ‘শিষ্টাচার’ মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রীদের শিষ্টাচারের একটা লেভেল মেনে চলা উচিত।’
এ ছাড়া এমপিদের সংবর্ধনার জন্য শিশুদের রাস্তায় দাঁড় না করাতে শিা মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করা হলেও কোনো মন্ত্রী-এমপি তার তোয়াক্কা করছেন না। সরকারের একাধিক মন্ত্রী-এমপি সংবর্ধনার নামে কোমলমতি শিার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখেন। রোদ, ধুলাবালুযুক্ত পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে শিশুরা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে একাধিকবার।
এর আগে গত সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন পদ্মা সেতু, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঘুষ কেলেঙ্কাার, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত শেয়ারবাজার, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিআরটিএ’র কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে থাপ্পড়, কক্সবাজারের এমপি আব্দুর রহমান বদিসহ অনেক মন্ত্রী-এমপি সাংবাদিক পেটানোসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ান। এতে বারবার বিব্রত হতে হয় সরকারকে।