বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। ৫ ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে এই দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নতুন জটিলতা। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে তৈরি হওয়া দূরত্ব নতুন সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। সরকারের নীতিনির্ধারণীমহল এ দূরত্ব কমানোর বিষয়টি উপলব্ধি করলেও তাতে সফল হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, দাতাগোষ্ঠী সরকার তথা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওপর ক্ষুব্ধ রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আইএমএফ সহজ শর্তে যে ঋণের নীতিমালা তৈরি করছে বাংলাদেশের অবস্থান এর বিপক্ষে। লিখিতভাবে এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আইএমএফের দক্ষিণ এশীয়বিষয়ক এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রাকেশ মোহনের বাংলাদেশ সফরে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। রাকেশ মোহনকে অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ভালো ঋণ পরিশোধকারী। তাই আমরা এর বিপক্ষে। এ ছাড়া নন-কনসেশনাল লোনের বিষয়টি বিশ্বব্যাংক তদারকি করে আসছে। সুতরাং এখানে আইএমএফের কোনও দরকার নেই। বিষয়টি বোর্ড মিটিংয়ে তুলতে নির্বাহী পরিচালককে অনুরোধ করেন অর্থমন্ত্রী।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় চলা বিভিন্ন ধরনের টানাপড়েনের পর নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় সরকার। বিশ্বব্যাংকের অর্থ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। দুর্নীতির অভিযোগ এনে সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর পদত্যাগ, সচিবসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ও চাকরি থেকে অব্যাহতিসহ তাদের নানা ধরনের নাজেহাল করার বিষয়গুলো সরকারকে বিব্রত করে।
নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তের পর এ প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়নে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে অপারগতা প্রকাশ করে এডিবি। ইআরডি-সূত্রে জানা গেছে, এডিবি চিঠি বাংলাদেশকে পদ্মা সেতুর দরপত্র মূল্যায়নে অস্বীকৃতি জানায়। এর আগে এডিবিকে দরপত্র মূল্যায়নের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সরকারকে লেখা চিঠিতে এডিবি বলেছে, যেহেতু এডিবি এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে না তাই এর কোনও কাজের সঙ্গে তারা যুক্ত থাকবে না। তাই দরপত্র মূল্যায়নে অপারগতা জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ‘ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-২ (সিএমডিপি)-এর আওতায় প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে এডিবি যেসব শর্ত দিয়েছে এর মধ্যে ‘ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট’ অন্যতম। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করার জন্য তাগিদ দিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দেয় এডিবি। গত বছর ডিসেম্বরে আইনটি পাসে এডিবি সরকারকে অনুরোধও জানায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতেই এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপনে এডিবিকে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এখন পর্যন্ত সংসদে তোলেনি সরকার। এডিবির মহাপরিচালক জোয়ান মিরান্ডা এ বিষয়ে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রীর কাছে। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি এডিবি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশের কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ তদারকির বিষয়ে আইএমএফ নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে সরকার। সংস্থাটির এ প্রস্তাব নজিরবিহীন আখ্যা দিয়ে অর্থমন্ত্রী আইএমএফের এ প্রস্তাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ বিষয়ে লেখা নোটে অর্থমন্ত্রী বলেন, আইএমএফের এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
বৈদেশিক ঋণের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে এ রকম একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে আইএমএফকে নিয়ে। ৯ জানুয়ারি ‘ডেট লিমিটস ইন ফান্ড প্রোগ্রামস উইথ লো ইনকাম কান্ট্রিজ’ শীর্ষক এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বাংলাদেশকে পাঠায় আইএমএফ। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইআরডির সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ও আইএমএফের কাছ থেকে সরকারকে অনেকটাই দূরে ঠেলে দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যে কোনও ধরনের তদারকি করা আইএমএফের ঠিক হবে না। আইএমএফকে সহজ শর্তের ঋণ তদারকির অনুমতি দেওয়াও সরকারের জন্য ঠিক হবে না। আমি দায়িত্বে থাকলে দিতাম না। দাতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা সৌজন্যের মধ্যেও পড়ে।
ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমদ আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের ঋণ তদারকি করা আইএমএফের সমীচীন হবে না। এটি আমাদের ঐতিহ্য নয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের রেকর্ড অত্যন্ত ভালো। প্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতাও সন্তোষজনক, তাই বিষয়টি বুঝিয়ে ওই তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আইএমএফের সঙ্গে কথা বলা উচিত বলেও মনে করেন ড. ফরাসউদ্দিন।