পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে ঢাকা

0
143
Print Friendly, PDF & Email

ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। এ বিপর্যয়ের প্রধান শিকার ঢাকার সাধারণ বাসিন্দা ও প্রাণিকুল। এর ভয়াবহতার মাত্রা এতটাই বেশি যে, বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী এক দশকে নগরীতে সুস্থ নাগরিকের সংখ্যা শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। এই নগরীর বাসিন্দারা নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পড়বে। ইতোমধ্যেই পরিবেশের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে মানুষের ওপর।
পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান উপকরণের মধ্যে রয়েছে বায়ু দূষণ, পানি দূষণ ও শব্দ দূষণ। আর এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঢাকা শহরের অবস্থান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষের তালিকায়। ইউএস ইউনিভার্সিটি অব ইয়েল অ্যান্ড কলাম্বিয়ার ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইন্ডেক্স’ অনুযায়ী বিশ্বের ১৩২টি দূষিত নগরীর মধ্যে বাংলাদেশ ৩১তম। মারসার কনসালটিং গ্রুপ পরিচালিত এবং এএফপি প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বসবাসের অনুপযোগিতার দিক থেকে এশিয়ার মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বায়ু দূষণের ফলে প্রতি বছর দেশে ১৫ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। পানি দূষণের কবলে পড়ে বিভিন্নভাবে মৃত্যুবরণ করছেন ৫০ হাজার মানুষ। শব্দ দূষণ থেকে সৃষ্ট রোগে মারা যাচ্ছেন প্রায় আট হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। এসব দূষণের কারণে শুধু ঢাকা শহরেই প্রতি বছর এক লাখ ৮০ হাজার নতুন রোগীর সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ঢাকা শহরে একজনও সুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অন্যান্য দেশের চেয়ে ঢাকায় দূষণের মাত্রা নিয়ে গত মাসে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এখানে বায়ু দূষণের মাত্রা ৭৭ দশমিক ২৭ ভাগ। খাবার পানির দূষণের মাত্রা ৬৯ দশমিক ৪৪ ভাগ, দৈনন্দিন গার্বেজ ব্যবস্থাপনায় অনুপযোগিতা থেকে দূষণ ৭২ দশমিক ২২ ভাগ, নোংড়া ও অপরিচ্ছন্নতা থেকে দূষণ ৮৩ দশমিক ৩৩ ভাগ, শহরে সময় অপব্যয়জনিত দূষণের মাত্রা ৭৫ ভাগ এবং সবুজ ও উদ্যানের অপর্যাপ্ততা থেকে সৃষ্ট দূষণের মাত্রা ৮৮ দশমিক ৮৯ ভাগ।
এসব দূষণের ফলে শুধু মানুষই নয়, ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় প্রাণিকুলেও দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রভাব। বিশেষ করে গাজীপুরে বনাঞ্চল এখন বন্য পশুপাখি শূন্য হওয়ার পথে। বায়ু ও পানি দূষণের ফলে উজাড় হচ্ছে বন। শহরের ভেতরেও কমে আসছে সবুজ চত্বর। গবাদি পশুপাখি, গাছপালা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিলীন হচ্ছে। ঢাকাকে ঘিরে রাখা চারটি নদীর পানি শিল্প-কারখানা ও মানব বর্জ্যরে লাগামহীন নির্গমনের ফলে চরম দূষিত। নদীগুলোতে প্রতি লিটারে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ৪ মিলিগ্রাম, যেখানে থাকার কথা ৪ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম থেকে ৮ মিলিগ্রাম। পানি বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীতে এখন আর কোনো মাছ বা জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব নেই। ঢাকার চার পাশে বিশেষত হাজারীবাগ, তেজগাঁও, ডেমরা ডিএনডির বাঁধ, শীতলক্ষ্যার উভয় তীর এলাকায় প্রায় সাত হাজার শিল্প-কারখানা এবং ট্যানারির বর্জ্য প্রাণঘাতী বিষ হয়ে এসব নদীর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে দূর-দূরান্তে। এ ছাড়াও ঢাকা সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী নগরীতে প্রতিদিন প্রতিজন মানুষ ৪০০ গ্রাম থেকে ৭০০ গ্রাম পর্যন্ত সলিড বর্জ্য ত্যাগ করছে। অথচ সিটি করপোরেশন মাথাপিছু মাত্র ২০০ গ্রাম বর্জ্য অপসারণ করতে পারছে। আবার যেগুলো অপসারণ করছে সেগুলোও ফেলছে নিকটবর্তী নদী ও জলাশয়ে। শহরের মোট তরল বর্জ্যরে ৬১ শতাংশ নির্গত হচ্ছে শিল্প-কারখানা থেকে এবং ৩৯ শতাংশ যাচ্ছে গৃহস্থালি থেকে। মোট বর্জ্যরে মাত্র ১০ শতাংশ শোধিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ট্রিটমেন্ট প্লান্টে।
বায়ু দূষণের প্রধান শিকার শিশুরা। যন্ত্রদানবের কালো ধোঁয়া, ইটের ভাটা, কল-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও অনিয়ন্ত্রিত ধূমপান ঢাকার বাতাসে সিসার মাত্রা মারাত্মক বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে সিসার মাত্রা ৪৬৩ নেনোগ্রাম, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর ঢাকায় প্রায় তিন হাজার জনের মৃত্যু ঘটছে। শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু।
শব্দ দূষণের প্রধান শিকার নারী ও শিশুরা। রাস্তাঘাটে যানবাহনে উচ্চ শব্দের হর্ন ব্যবহারের ফলে ছোট বেলা থেকেই শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের শ্রবণেন্দ্রীয় সংকুচিত ও ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ফলে একটি বয়সে শ্রবণশক্তি হারিয়ে তারা প্রতিবন্ধীতে পরিণত হচ্ছে। সন্তানসম্ভবা মহিলারাও শব্দ দূষণে জর্জরিত হয়ে জটিল সমস্যায় ভুগছেন এবং জন্ম দিচ্ছেন বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী সন্তান। ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকার ৮৬ ভাগ মানুষই যানবাহনের হর্ন, কল-কারখানার শব্দ, উড়োজাহাজের উড্ডয়ন অবতরণের শব্দ, নির্মাণ কাজ, উচ্চ শব্দে গানবাজনা ইত্যাদি শব্দজনিত বিপর্যয়ের শিকার।
পরিবেশ বিপর্যয়ের এত ভয়াবহতার কারণে দিন দিন ঢাকা শহর মানুষের বসবাস অনুপযোগী হয়ে উঠছে। পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও পুলিশ বিভাগ নিয়োজিত থাকলেও এদের কাছ থেকে কোনো সুফল নগরবাসী পাচ্ছেন না। প্রয়োগে শিথিলতা ও দুর্নীতির কারণে বিদ্যমান আইনেও পরিবেশ দূষণ ও এর সাথে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। প্রতিরোধ ও জনসচেতনতার অভাবে বিপর্যয়ের মাত্রা ক্রমান্বয়ে ভয়াবহতর হচ্ছে, বাড়ছে প্রাণহানিসহ মরণঘাতী ব্যাধির সংক্রমণ।

শেয়ার করুন