নগর সরকারই ঢাকাকে রক্ষা করতে পারে

0
224
Print Friendly, PDF & Email

স্থপতি ইকবাল হাবিবের জন্ম ১৯৬৩ সালে। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। হাতিরঝিল প্রকল্পের এরিয়া ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড বিল্ডিং ডিজাইন প্রকল্প এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন নকশার সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি তিনি পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নগরায়ণ ও সুশাসন-সংক্রান্ত উপকমিটির যুগ্ম সম্পাদক। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন ঢাকার বর্তমান অবস্থা ও নগরপরিকল্পনা বিষয়ে।

ঢাকাকে আমরা মেগা সিটি বলি, শহরটির ওপর জনসংখ্যার চাপও অসম্ভব। এ ধরনের একটি শহরের জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে তো পরিকল্পনার লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না।

ঢাকাকে আমরা রাজধানী হিসেবে পাই ১৯৭১ সালের পর। ঢাকার পরিকল্পনা বলতে ১৯৫৯-৬০ সালের একটি পরিকল্পনা আমরা পাই।  কিন্তু রাজধানী হওয়ার পর আশির দশক থেকে বলা যায় দ্রুত নগরায়ণ শুরু হয়, সেটা অপরিকল্পিত। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক ও কেন্দ্রীভূত সরকার হওয়ায় সরকার পরিচালনা থেকে শুরু করে দেশের প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সবকিছুরই কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ঢাকা। ১৯৫৯-৬০ সালের যে মাস্টার প্ল্যান, সেখানে ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চল ও নদী, শহরের খাল, বিল-ঝিল—এসব রেখেই উন্নয়ন অর্থাৎ এই শহরটির যে প্রাকৃতিক গঠন, সেটা বিবেচনায় নিয়ে একধরনের জলের সঙ্গে বসবাসের পরিকল্পনা ছিল। আশির দশকে এসব বিবেচনায় না নিয়ে একধরনের লাগামছাড়া নগরায়ণ শুরু হয়। ১৯৫৯-৬০ সালের মাস্টার প্ল্যানও মানা হয়নি বা নতুন কোনো পরিকল্পনাও নেওয়া হয়নি। ফলে যাচ্ছেতাইভাবে শহরটি গড়ে উঠতে থাকে এবং এর যে প্রাকৃতিক গঠন ও ঐশ্বর্য ছিল, তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

১৯৯৪ সালে ডিএমডিপি বা ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এটাই ঢাকার প্রথম কাঠামো পরিকল্পনা, ২০১৫ সাল মেয়াদি এই পরিকল্পনায় তিন বছরের মধ্যে ড্যাপ বা ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান তৈরির কথা বলা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ভূমি ব্যবহার ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নির্দেশনা দেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, যেদিন ড্যাপ পাস হয়, সেদিনই কিছুসংখ্যক ভূমি ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধি, যাঁদের অনেকে এসব ভূমি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা প্রবল আপত্তি তোলেন এবং ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করে। ফলে ড্যাপ যেমন কার্যকর করা গেল না, তেমনি আমরা দেখলাম ড্যাপের পরিকল্পনায় যা ছিল তার অনেক কিছুই এরই মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ড্যাপ পাস হওয়ার পর তা অমান্য করে যেসব কাজ হয়েছে, তা জায়েজ করার জন্য এখন সরকার রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান নামে নতুন কাঠামো প্ল্যান তৈরির পরিকল্পনা করছে।

ড্যাপের বিরোধিতা করছেন ভূমি ব্যবসায়ীরা। যাঁরা গরিব মানুষের জমি কম দামে কিনে বড়লোকের কাছে বিক্রি করছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কিছু জনপ্রতিনিধি, যাঁদের অনেকে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় রয়েছে, তা হচ্ছে নির্বাচনী রাজনীতি ও আপাতজনপ্রিয়তা। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সব সময়ই কঠিন কাজ। যৌথ স্বার্থ নিশ্চিত করতে গেলে কখনো ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে। ফলে ড্যাপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণকে সঙ্গে নেওয়া বা এর পক্ষে যথাযথ প্রচারণার যে উদ্যোগ সরকারের তরফে নেওয়া দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়নি। ফলে ভূমি ব্যবসায়ীরা এর বিরোধিতার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু এই ভূমি ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কাছে তো ঢাকা শহর, এর নাগরিক ও শহরটির ভবিষ্যৎ ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না।

১৯৯৪ সালের ডিএমডিপি কাঠামো পরিকল্পনার অধীনে যে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী নিম্নাঞ্চল, খাল বা জলাভূমি এসব অক্ষুণ্ন রেখে ঢাকা শহরে এক কোটি ৭৬ লাখ মানুষের আবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। ফলে যাঁরা বলছেন যে ঢাকা শহরের জমি কম, সে জন্য জলাভূমি ভরাট করতে হবে; তাঁরা আসলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে তাঁরা ঢাকা শহরটির সর্বনাশ করেছেন এবং চূড়ান্ত সর্বনাশ নিশ্চিত করতে ড্যাপের বিরোধিতা করছেন। সব মানুষের জন্য একটি আবাসন পরিকল্পনা থাকলে এই বিষয়গুলো এড়ানো যেত। সরকার বা বেসরকারি কোনো তরফেই এ ব্যাপারে আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

ড্যাপ বাস্তবায়ন করা না গেলে বা ঢাকার জলাভূমি, খাল বা নিম্নাঞ্চল রক্ষা করা না গেলে ডিএনডি বাঁধের যে পরিণতি হয়েছে, পুরো ঢাকাই সে পরিণতি পেতে পারে। ডিএনডি বাঁধ দেওয়া হয়েছিল ঢাকাবাসীর চাহিদা পূরণে কৃষি খামার করার উদ্দেশ্য নিয়ে। স্বাধীনতার পর আমরা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। মানুষ সেখানে আবাসন গড়েছে। এলাকাটি বিভিন্ন সময়ে সাত-আট ফুট পানির নিচে ডুবে থাকে। ঢাকার যে প্রাকৃতিক গঠন, আমরা যদি নিম্নাঞ্চল, জলাভূমি, খাল ও চারপাশের নদীগুলোকে ঠিকভাবে রক্ষা করতে না পারি, তবে
একসময় ডিএনডির পরিণতি হতে পারে এই শহরটির।

ঢাকার যে অবস্থা, তাতে বলা যায় আমরা একটি ক্রসরোডে এসে দাঁড়িয়েছি। এখনই সরকারকে দৃঢ়ভাবে ড্যাপসহ স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারকে এই অবস্থান নিতে হবে যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো বিবেচনা বা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে কোনো আপস করবে না। আমি মনে করি, সরকার যদি সময়নির্ভর ও জবাবদিহিমূলক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, তবে ঢাকায় কাঙ্ক্ষিত জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং এর বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব। হাতিরঝিলের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে এ ধরনের অনেক কিছুই সম্ভব।

ঢাকাকে দেখভাল করার জন্য আগে ডিআইটি এবং পরবর্তী সময়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ছাড়া আসলে তেমন কেউ নেই। নগর পরিকল্পনা, ইমারত নির্মাণ অনুমোদন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ—এ তিনটি মূল কাজ এই কর্তৃপক্ষের হলেও বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণে এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে এই শহরটিকে সব মানুষের শহরে পরিণত করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ তারা নিতে পারেনি। তাদের উন্নয়ন-কাঠামোটি যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। তারা মূল যে কাজটি করেছে তা হচ্ছে, নিম্নাঞ্চল বা কৃষিনির্ভর জমি জনগণের কাছ থেকে সস্তায় কিনে বড়লোকদের দেওয়া। এ ধরনের কাজই তারা করেছে এবং এখনো করে চলেছে। আর শহরটি শুধু রাজউকের নিয়ন্ত্রণেও নেই, সরকারের প্রায় ১১টি মন্ত্রণালয় ও ৫৪টি সংস্থা ঢাকার নানা উন্নয়নকাজ ও দেখভালের সঙ্গে জড়িত। এগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কার কী কাজ, সেটা স্পষ্ট নয়। ওয়াসা দীর্ঘদিন হাতিরঝিলকে সুয়ারেজ ও ড্রেনেজের কাজে ব্যবহার করেছে, এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আবার সিটি করপোরেশনের। ঢাকা শহরের কোনো কিছু দখল হয়ে গেলে এক সংস্থা আরেক সংস্থাকে দায়ী করে। নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের এই জগাখিচুড়ি অবস্থা এই শহর নিয়ে পরিকল্পনা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। একটি জবাবদিহিমূলক নগর সরকার এ ধরনের বিশৃঙ্খলা দূর করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

ড্যাপ মূলত ঢাকা নগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। আসলে ঢাকাকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এই যে ঢাকামুখিতা বা ঢাকাকেন্দ্রিকতা, এটা দূর করতে পুরো দেশের প্রতি ইঞ্চি জায়গার সমন্বয়ে ভূমি ব্যবহারের ত্রিমাত্রিক ভৌত মহাপরিকল্পনা করতে হবে। এই কার্যক্রম কঠোরভাবে নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারের পরিচালনার কার্যক্রম, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি ঢাকার চারপাশের যে শহরগুলো রয়েছে যেমন টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ—এ শহরগুলোকে স্থানীয় সরকার-কাঠামোর অধীনে দ্রুত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

লুই কান যত কাজ করেছেন, তার মধ্যে আমাদের সংসদ ভবনটি সেরা। পরিসর, স্থাপনা ও বৃক্ষ—এই তিনের সমন্বয় ঘটেছে এখানে। সড়ক ও বৃক্ষ দিয়েই এর সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যে মূল পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। মেট্রোরেলের নামেও এই স্থাপনার নির্ধারিত এলাকার ৫০ মিটার জমি খেয়ে ফেলার উদ্যোগ চলছে। যা-ই হোক, সংসদ ভবনে বেড়া দেওয়ার বিরুদ্ধ স্থপতিরা মাঠে নেমেছেন। প্রতিবাদ করেছেন। শুনেছি যে এই উদ্যোগ বর্তমানে স্থগিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মূল নকশা ফিলাডেলফিয়া থেকে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। আশা করছি, সংসদ ভবন ঘিরে বেড়া বানানোর উদ্যোগ থেকে সরকার সরে আসবে।

এ ধরনের বিশ্বকাপ আয়োজন আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। এর মধ্য দিয়ে আমরা বাইরের লোকজনের কাছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এসব তুলে ধরতে পারি। এর আগে সাফ গেমস বা সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আগে দেশের শিল্পী, ভাস্কর বা স্থপতি—এ ধরনের লোকজনকে ডেকে নিয়ে সরকারের তরফ থেকে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে সামগ্রিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কী করা যায়, সে ব্যাপারে। কাজগুলোর বাস্তবায়ন পেশাদার ঠিকাদার থেকে শুরু করে যে কেউই করতে পারেন; কিন্তু কী করা হবে, সে সিদ্ধান্ত তো একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার আওতায় এবং যথাযথ লোকজনের কাছ থেকে আসতে হবে। এবার দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। প্রশাসকনির্ভর একধরনের ব্যবস্থা ও জবাবদিহির অভাব থাকলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

শেয়ার করুন