ভাইয়া, আমাকে ছাত্রলীগের ছেলেরা মেরেছে। আমি হাসপাতালে ভর্তি। আমার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এখানে কোনো চিকিৎসাও হচ্ছে না। তোমরা তাড়াতাড়ি আমার এখানে এসো। আমাকে প্রচণ্ড মেরেছে। পাঁচটা স্টাম্প দিয়ে মেরেছে। সারা শরীরে মেরেছে।’
হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে বড় ভাইকে এভাবে কথাগুলো বলেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নির্যাতনে নিহত মেধাবী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা সায়াদ ইবনে মোমতাজ। গতকাল শুক্রবার নিহত সায়াদের বড় ভাই মোয়াজ ইবনে মোমতাজের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি এসব কথা জানান।
মোয়াজ বলেন, ‘সায়াদ হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুবার আমার সঙ্গে কথা হয়। সোমবার রাত দুইটার দিকে প্রথমবার একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে কথাগুলো বলে। এরপরই ফোন কেটে যায়। আমি বাসায় এবং ময়মনসিংহে তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। সায়াদের সাথে শেষবারের মতো কথা হয় মঙ্গলবার সকাল নয়টা ৪০ মিনিটে। এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে সায়াদ বলছিল, “ভাইয়া, আমি খুব কষ্টে আছি। আমার চিকিৎসা মনে হয় আরম্ভ হচ্ছে।”’
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সায়াদকে প্রথমে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাঁর পাশের বেডে থাকা রোগীর এক আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, ওই রাত নয়টার দিকে সায়াদকে যখন ৮ নম্বর ওয়ার্ডে আনা হয় তখন তিনি ছিলেন নিথর। তবে তাঁর পাশে কেউ ছিল না। ওয়ার্ডের ৫ নম্বর বেডের নিচে তাঁকে কাঁথা পেতে শুইয়ে রাখে ওয়ার্ডবয়। তাঁর দুই হাত, কোমর ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তিনি ব্যথায় নড়তে পারছিলেন না।
এই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ‘সারারাত মেঝেতে পড়ে থাকলেও কোনো ডাক্তার আসেননি। ব্যথায় সারারাত তিনি কাতরাচ্ছিলেন। এ পর্যায়ে আমার কাছ থেকে মুঠোফোন চান। আমি তাঁর বাবার ফোন নম্বর চাইলে তিনি তাঁর ভাইয়ের নম্বর দেন। পরে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন।’ তিনি জানান, এরপর তিনি এক বন্ধুকে কয়েকবার ফোন দিলেও বন্ধুর কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি। এরপর তিনি আমাকে ফেসবুকে ঢুকতে বলেন। ফেসবুকে তিনি এক বন্ধুর কাছে মেসেজ পাঠান, ‘আমি খুব বিপদে আছি, আমাকে তোরা বাঁচা।’
এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘রাত ১২টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত আমি ওয়ার্ডেই ছিলাম। সকাল সাতটার দিকে একজন লোক আসেন। তখন সায়াদ তাঁকে ব্যাকুল কণ্ঠে বলেন, “ভাই, আপনি এত পরে আসলেন? আমার অবস্থা খুব খারাপ। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান।” এরপর সায়াদকে আর হাসপাতালে দেখিনি।’
বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসক আবুল কালাম আজাদ জানান, ‘আবাসিক হলে যখন আমি সায়াদকে দেখতে যাই, তখন তাঁকে নাম জিজ্ঞেস করলে শুধু নাম বলতে পারেন। কিন্তু হাত-পা নড়াচড়া করতে পারেননি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন শাখা সূত্রে জানা যায়, ওই রাতে সাত-আটজন মিলে অ্যাম্বুলেন্সে করে সায়াদকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সটি তাঁদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরত আসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্স ইস্যুকারী মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সায়াদের ওই রকম অবস্থা দেখে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ি। পরে কর্তব্যরত ডাক্তার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত জানালে আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসি।’
তবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ওই রাতে দায়িত্ব পালনকালী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্রাদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে (সায়াদ) যখন ওয়ার্ডে আনা হয়, তখন তিনি অজ্ঞান ছিলেন।
সায়াদকে কে বা কারা বেসরকারি ক্লিনিক ট্রমা সেন্টারে নিয়ে গেল তা জানেন কি না জানতে চাইলে তাঁর বড় ভাই মোয়াজ বলেন, ‘তা আমরা জানতে পারিনি।’