পূর্ব-উত্তরাঞ্চলের কৃষি পরিবেশসহ জনজীবন বিপর্যয়ের মুখে

0
206
Print Friendly, PDF & Email

সরদার আবদুর রহমান : ভারতের বাঁধ ফারাক্কা বাংলাদেশের পদ্মাকে আগেই মেরে ফেলেছে। এবার ভারত ব্রহ্মপুত্রের বিপুল পানির ভা-ার সরিয়ে নিয়ে নির্মাণ করে চলেছে বহু প্রকল্প। ব্রহ্মপুত্রের যেসব উপনদী রয়েছে সেগুলো থেকেও পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর ফলে ব্রহ্মপুত্র শুধু মূল উৎসই নয়- অন্যান্য উৎসের পানি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। একারণে বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ, পানিসম্পদ, কৃষি অর্থনীতি এবং যোগাযোগের অন্যতম বৃহৎ উৎস যমুনা নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হবার মুখে পড়েছে। বিভিন্ন বাঁধ ও ব্রীজের প্রতিবন্ধকতায় এই নদী এখনই শীর্ণ দশায় পতিত হয়েছে। আগামী সিকি শতাব্দীর মধ্যে যমুনা একটি মরা খালে পরিণত হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

ভারতের উৎসমুখ থেকে আসা ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর প্রবাহ একসঙ্গে ধারণ করে যমুনা বিপুল জলরাশি নিয়ে বিস্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবহমান ছিল। কিন্তু ভারতের অংশে ব্রহ্মপুত্রে বহুসংখ্যক পানিবিদ্যূত ও সেচ প্রকল্প নির্মাণ ছাড়াও যমুনার বুকে বৃহৎ সেতু স্থাপনা নির্মাণের ফলে স্বাভাবিক স্রোতধারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এর প্রবাহ প্রতিদিন হ্রাস পেয়ে চলেছে। নদীর বুকে অসংখ্য স্থায়ী চর সৃষ্টি হচ্ছে। মূলধারা সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে পড়ছে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর বৃহত্তম নদীগুলোর অন্যতম ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি তিব্বতের মানস সরোবরের নিকট চেমাইয়াংডুং হিমবাহ থেকে। অতঃপর তা উত্তর-পূর্বে পুরো আসামের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় সোয়া ৭শ’ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে ধুবরী নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে যমুনা নাম নিয়ে এই নদী গাইবান্ধা, বগুড়া, পাবনা, জামালপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলার সীমানা ছুঁয়ে গোয়ালন্দের কাছে পদ্মায় মিলিত হয়েছে। যমুনার একটি শাখা ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’ নাম ধারণ করে মোমেনশাহী-জামালপুরের ভেতর দিয়ে ভৈরব বাজারের নিকট মেঘনা নদীতে পড়েছে। উৎপত্তিস্থল থেকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মোট দৈর্ঘ ২ হাজার ৭শ’ ৩৭ কিলোমিটার। বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ ২শ’ ৭৭ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্র প্রতিবছর গড়ে ৫২৭ মিলিয়ন টন পলি বহন করে। ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বাংলাদেশ ৬৭ শতাংশ প্রবাহ পেয়ে থাকে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার উপনদী ও শাখা-প্রশাখার মধ্যে রয়েছে, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, হুরাসাগর, সুবনসিঁড়ি, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, পৌলী, দুধকুমার, ধরিয়া, ঘাঘট, কংস, সুতলা  প্রভৃতি। এসব নদীর অববাহিকা হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বিস্তৃত অববাহিকা। যমুনার মৃত্যু হলে এসব নদীও হারিয়ে যাবে প্রকৃতি থেকে।

তথ্যে প্রকাশ,  ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক যমুনার মূল নদী ব্রহ্মপুত্রে পানির বেশ ক’টি সঞ্চয়াগার নির্মাণ করছে। এছাড়া তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতরাজ্যের উন্নয়ন পরিকল্পনা মোতাবেক এই নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধসহ ১৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিয়েছে। এসব বাঁধ-প্রকল্প পূর্ব ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিদ্যুত উৎপাদন ও সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পগুলোর জন্য মূল ব্রহ্মপুত্র নদে এবং এর শাখাগুলোতে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে এবং ব্যাপকহারে পানি প্রত্যাহার করতে হবে। তবে এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের বেলায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ ভূমিতে ব্যাপক ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি। এদিকে, ভারত তিস্তা নদীর উপর বাঁধ দেয়ায় শুধু তিস্তার প্রবাহই মার খায়নি- যমুনাতেও তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। যমুনায় ইতোমধ্যে পানির প্রবাহ এখনই অনেকাংশে কমে গেছে। আর নদীর বুক ভরাট হয়ে বালির চর পড়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রহ্মপুত্রের উপর নয়া বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত এর সকল শাখা-উপশাখা নদীই প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। বিশেষ করে যমুনা নদী পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। আর উত্তরাঞ্চলের যমুনার তীরের এলাকাগুলো পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। যা কৃষিক্ষেত্রের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করবে। তাছাড়াও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যার ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিবে। এমনকি বন্যা নাও হতে পারে। নদীনির্ভর বা বন্যানির্ভর চাষাবাদ একেবারই বন্ধ হয়ে যাবে। ফসল উৎপাদন কমে যাবে এবং ক্রমশঃ খাদ্য ঘাটতি দেখা দিবে। সব মিলিয়ে উত্তরাঞ্চল হবে মরুপ্রক্রিয়ার শিকার।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারত ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে টিপাইমুখসহ ১২টি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ শেষ হয়েছে ৪টি, বাস্তবায়নাধীন রয়েছে ৩টি এবং পরিকল্পনাধীন রয়েছে আরো ৫টি। সবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। ব্রহ্মপুত্র নদীকে ঘিরে ভারত যে সকল প্রকল্প গড়ে তুলেছে এর মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। তথ্যে প্রকাশ, ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র দু’টি অববাহিকায় পানির ৩৩টি সঞ্চয়াগার নির্মাণ করবে। প্রতিটি সঞ্চয়াগারের ধারণ ক্ষমতা হবে ১ লাখ ৫০ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ ৩৩টি সঞ্চয়াগারের সর্বমোট ধারণ ক্ষমতা হবে প্রায় ৫০ লাখ কিউসেক পানি। এ পানি ভারতের পূর্ব, মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। এর আওতায় থাকবে ৩ কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমি। পাশাপাশি উৎপাদন করা হবে ৩০ হাজার মেগাওয়াট পানি বিদ্যুৎ। সব মিলে খরচ হবে প্রায় ১শ’ বিলিয়ন ডলার। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁধসমূহের সাথে ৩৩টি সঞ্চয়াগার প্রতিস্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে স্থাপিত বাঁধের মাধ্যমে ভারত ৩৫ লাখ কিউসেক পানি ধরে রেখেছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত এসব সঞ্চয়াগারের মাধ্যমে ধরে রাখতে সক্ষম হবে ৫০ লাখ কিউসেক পানি। বাড়তি ১৫ লাখ কিউসেক পানির ঘাটতি বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে।

অপরদিকে, যমুনা সেতু নির্মাণের কারণেও এই নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। এ থেকে সৃষ্ট পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে সেতু এলাকায় পরিবেশগত বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। উত্তাল তরঙ্গমালার যমুনা সেতুর তলদেশে ও আশেপাশে বিশাল আকৃতির চর জেগেছে। ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির নিচে মাঝ বরাবর পূর্ব পশ্চিমে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী বক্ষ ধূ ধূ বালুচরে পরিণত হয়েছে। যমুনা সেতুর পরিবশেগত বিরূপপ্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৎস সম্পদ। বেকার হয়ে পড়ছেন মৎসজীবীরা। এর শাখা কয়েকটি নদী শুকনো মওসুমের শুরুতেই বালুচরে পরিণত হয়েছে। সেতুর নিরাপত্তার লক্ষ্যে যমুনার গতিপথ পরিবর্তনের সম্ভাবনা দূর করার জন্য ধলেশ্বরীর উৎস মুখ বন্ধ করা হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর ফসলী জমি। যমুনা সেতু নির্মাণের ফলে সাময়িকভাবে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের উপকার হয়েছে ঠিকই। তবে সেতুর নির্মাণজনিত পরিবেশগত সমস্যাকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেতু নির্মাণের সময়ে এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল ধলেশ্বরী নদীর উত্তর উৎসমুখ বন্ধ হলে এর প্রভাব পড়বে ৬০ হাজার ৭শ’ হেক্টর এলাকায়। সমীক্ষার সমস্ত সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে খোদ যমুনা নদীই মরে যাবার উপক্রম হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর উৎস মুখ বন্ধ হয়ে যাবার ফলে হাজার হাজার একর জমি চাষাবাদের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে।

শেয়ার করুন