একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অপহরণ সংঘর্ষ চুরি থেকে শুরু করে বিরোধী নেতাকর্মীদের দমন সবই করছেন তারা। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়ে চললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই দায় সারছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা। ফলে ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটি। এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই বছর আগে। অথচ নতুন কমিটি গঠনের কোনো উদ্যোগই লক্ষ করা যাচ্ছে না। বর্তমান কমিটির এক বছরের বাইরে আরো প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করার কারণে নেতাকর্মীরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ড. এ এম আমজাদ বলেন, নির্বাচনের পর ছাত্রলীগের সব কর্মই বেড়েছে। সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়লে ভালো। তবে অপতৎপরতা বাড়লে সেটি বাঞ্ছনীয় নয়। তাদের নেতাকর্মীরা অন্যায় করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কমিটির মেয়াদ শেষ হলে নতুন পদপ্রত্যাশীদের তৎপরতা বাড়ে। এখন হয়তো ছাত্রলীগে তেমনটিই হচ্ছে। ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর অপকর্মের কারণ হিসেবে এ বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যায় না বলেই মন্তব্য করেন তিনি।
গত তিন মাসে ছাত্রলীগের যত অপকর্ম : গত ২৬ মার্চ বুধবার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গিয়ে বহিরাগতদের হয়রানির শিকার হলে কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরা রাতেই আন্দোলন করে ভিসির কাছে অভিযোগ জানান। এ ছাড়া হলের গেট ভাঙচুর ও ছাত্রলীগ সভাপতি আজমিরা বিনতে জামান নীলার ব্যানার ছিঁড়ে অগ্নিসংযোগ করেন। ওই ঘটনার রেশ ধরে বৃহস্পতিবার রাতে হলে সুমাইয়া ইসলাম নামে এক ছাত্রীকে হল ছাত্রলীগের সভাপতি নীলা ও সাধারণ সম্পাদক লীসা আটকে রেখে শিবির আখ্যা দিয়ে মারধর করে। পরে সাধারণ ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ড. এ এম আমজাদ বাধ্য হয়ে তাদের গাড়িতে করে হল থেকে বের করে নিয়ে যান।
২২ মার্চ বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগ কর্মী হায়দার আলীকে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক করে জেলহাজতে পাঠায় শাহবাগ থানা পুলিশ। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চারুকলা অনুষদ সংলগ্ন ছবির হাটে শুটিং ইউনিট থেকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
২০ মার্চ দুপুরে কার্জন হলে পূর্বশত্রুতার জেরে শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন আহত হন। একই দিন ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মেহেদী হাসানের পিটুনিতে হলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাবির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংগঠন সেøাগান-৭১ এর সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল সুজন আহত হন।
গত ৪ মার্চ রাতে জুতা চুরিকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ৯ জন এ ঘটনায় আহত হন। ওই দিন সংঘর্ষ চলাকালে বিপুল রড এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হলে মহড়া দেয়া হয় বলে খবরে প্রকাশ। পরের দিন এ ঘটনা নিয়ে মধুর ক্যান্টিনের সামনে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন হলের দুই নেতা সাদ্দাম ও সোহাগ। এ ঘটনায় হল শাখা ছাত্রলীগের তিন পদধারী নেতা এবং চার কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
২ মার্চ রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রদল কর্মীকে অমর একুশে হল থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। তারা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত নিয়মিত ছাত্র। বের করে দেয়া তিন কর্মী হলেন মো: আবি আবদুল্লাহ, আল আমিন ও মো: সুজন মোল্লা।
২৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়াউর রহমান হল থেকে ছাত্রদল কর্মী এমদাদুল ইসলাম এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে আবদুল হালিম নামে এক ছাত্রকে শিবির অভিযোগে বের করে দেয়া হয়।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি খাবার দিতে দেরি হওয়ায় হোটেলে তালা লাগিয়ে দেন শহীদুল্লাহ হলের ছাত্রলীগ কর্মী শাহরিয়ার। এর আগের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে জসীমউদ্দীন হলের ৩১৬ নম্বর রুমে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ছাত্রলীগ কর্মী রাফসান জনি পরশ পড়ে গিয়ে মাথা ফাটান।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল ছাত্রলীগের নেতা মাহবুব বহিরাগত একজনকে অপহরণ করে হলে আটকে রাখেন। রাতভর নির্যাতন শেষে রোববার সকালে যুবককে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। রাজধানীর প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের এক দোকানদারের চুরি হওয়া ৮০ হাজার টাকা উদ্ধার করতে অপহরণ করা হয় বলে পরে জানা যায়। এ ঘটনায় তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়। তারা হলেন মাহবুব (দর্শন বিভাগ, মাস্টার্স), সাইদুল ইসলাম (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ), মাহবুবুর রহমান (লোকপ্রশাসন বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ)।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার মধ্যরাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রথম বর্ষের ৯৭ জন ছাত্রকে হলে উঠতে দেয়ার কথা বলেও ওঠায়নি ছাত্রলীগ। এতে ওই ছাত্ররা রাতে চরম বিপাকে পড়েন।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে ছাত্রলীগের ছাত্রী নেত্রী ও কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে কয়েকজন ছাত্রী আহত হন।
গত ২৯ জানুয়ারি গভীর রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান শাহবাগের পিকক বারে মদপান করতে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ওই দিন ছাত্রলীগের কমপক্ষে ২০ জন নেতাকর্মী আহত হয়। এর জেরে হলের সভাপতি মেহেদী হাসানকে সাময়িক বহিষ্কার এবং সাধারণ সম্পাদক দিদার মোহাম্মদ নিজামুল ইসলাম ও জিয়া হল ছাত্রলীগ সভাপতি আবু সালমান প্রধান শাওনকে সতর্ক করে দেয়া হয়।
গত ২৮ জানুয়ারি শিবির অভিযোগে ইমরান হোসেন (ইংরেজি, মাস্টার্স) নামে এক ছাত্রকে বেদম পিটুনি দেয় মুহসিন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
গত ১ জানুয়ারি বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল থেকে ছাত্রলীগের পদধারী এক নেতাকে ছাত্রদল করার অভিযোগে পিটিয়ে বের করে দেয়া হয়। বের করে দেয়া ওই নেতার নাম আব্দুল আলিম। তিনি হল শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক এবং ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। থাকতেন হলের ২২৭ নম্বর রুমে। পরে আবার তাকে হলে ফিরিয়ে নেয়া হয়।
দুই বছর আগে মেয়াদ শেষ বর্তমান কমিটির : ২০১১ সালের ১০ জুলাই ছাত্রলীগের ২৭তম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেহেদী হাসান মোল্লাকে সভাপতি ও ওমর শরীফকে সাধারণ সম্পাদক করে এ কমিটি ঘোষিত হয়। এর পরের বছরের মে মাসে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১২ সালের ১০ জুলাই সে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির দুই বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১২টি ছাত্র হলের মধ্যে বেশ কয়েকটি এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেনি।
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি জেলা শাখার মর্যাদা দেয়া হয়। সে হিসেবে এ কমিটির মেয়াদ হওয়ার কথা এক বছরে, যা ২০১২ সালের ১০ জুলাই শেষ হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জেলা শাখার মেয়াদ এক বছর। কিন্তু বর্তমান কমিটি প্রায় এক বছর আট মাস অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছে। নতুন কমিটি গঠনের জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগই নেয়নি বর্তমান কমিটির নেতারা। নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করায় নেতাকর্মীরা নেতৃত্বের প্রতি অনীহা জানাচ্ছেন বলে অভিযোগ অনেকের, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অপকর্ম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বলছেন তারা। এতে ুণœ হচ্ছে সংগঠনটির ভাবমূর্তি।
তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন বর্তমান কমিটির সভাপতি মেহেদী হাসান মোল্লা। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সবকিছুই ভালোভাবে চলছে। তবে নতুন কমিটি তো অবশ্যই হবে। ম্যাডাম সরাসরি এ বিষয়ে দেখাশোনা করেন। তিনি এবং কেন্দ্রীয় কমিটি যখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তখনই নতুন কমিটি হবে।
নেতাকর্মীদের অপকর্মের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা খারাপ কাজ করছে তারা ছাত্রলীগের আদর্শকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পারেনি। যে কারণে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। যখনই কোনো সমস্যা হয়েছে তখনই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।