বাংলাদেশের এ রকম আনন্দের মুহূর্ত কমই এসেছে। তাসকিনকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন সাকিব। মুশফিকুর রহীম; তামিম ইকবাল; এনামুল হক বিজয়
৮ দলের ছয়টি ফিরে গেছে আগেই। ইতোমধ্যে সুপার টেনের কয়েকটি দেশ দেশে ফিরেছে। এখন ১৬ দলের বিশ্বকাপ লড়াই এসে পৌঁছেছে চার দলে। টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিলেও স্বাগতিক বলেই দেশে ফেরা বলে কিছু নেই বাংলাদেশের। তবে আছেও! দীর্ঘ দিন জাতীয় দলের ক্যাম্পে থেকে হাঁপিয়ে ওঠার মতোই অবস্থা জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের। এখন রিল্যাক্স। ছুটছেন যে যার আপন ঠিকানায়। প্রিয়জনদের সাথে দেখা হবে থাকছে সে আনন্দ। পেছনে রেখে গেলেন কী, তা হয়তো সাময়িকভাবে ভুলেই যাবেন। এমনিভাবে ভুলে যাবেন সব দেশের মানুষও। কী চেয়েছিলেন, কী প্রত্যাশা ছিল তাদের। ভুলে যাবে আর ক’দিন পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবিও। বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানে ছিল যত শঙ্কা। তা কাটিয়ে শুরু। এটি ওভারকাম করে সুন্দর এক আয়োজনে সহযোগিতা দিতে পেরেছে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিকে। প্রচুর অর্থ খরচ করা এ বিশ্বকাপে কী লাভ হলো, ক্ষতি কী, সে হিসাব মেলানোর পর্ব শুরু হয়ে গেল। আপাতত নিজ দেশে এত বিপুল অর্থ খরচ করে বিশ্বকাপ আয়োজন করে সেখানে নিজের দল কী করল তা নিয়ে এখন মুখে মুখে আলোচনা। আছে ব্যর্থতার কথা, আছে পাওয়া না পাওয়ার হিসাবও। কী প্রত্যাশা ছিল, সে উত্তর সবার জানা! নিজ মাঠে প্রথম রাউন্ডের গন্ডি পেরিয়ে সুপার টেনে খেলা। আর যেহেতু নিজের মাঠেই খেলা, সেখানে অন্তত ভালো কিছু রেজাল্ট। যেমন লড়াইয়ে হার বা নেদারল্যান্ডের মতো (ইংল্যান্ডকে হারানো) একটা জয়ও। এই তো! চ্যাম্পিয়ন হওয়া বা সেমিফাইনালে যাওয়া এগুলো বোধ হয় কোনো উন্মাদও আশা করেনি। কেন এগুলো চাওয়া ছিল তার উত্তরও সবার কাছে আছে। যে উইকেটে স্পিনের দাপট। যেখানে বাংলাদেশ দল স্পিনে অন্যতম সেরা দল বিশ্বে এমন নজিরও আছে (নিউজিল্যান্ডসহ বড় বড় দলগুলোকে হারানোর সুবাদে)। সেখানে চেনা উইকেটে নিজেদের মতো ব্যাটিং করে স্পিন দিয়ে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করে, রেজাল্ট বের করা। হিসেব খুব সহজই। কিন্তু হলো কিছু? না! হয়নি। এর কারণ এবার খোঁজার পালা।
দর্শক বা ক্রিকেটপ্রেমীরা যে প্রত্যাশার দ্বার উন্মোচিত করে রেখেছিলেন, তা অর্জনের জন্য বিসিবি কতটা সহায়ক ভূমিকা রেখেছে তা-ই এখন আলোচনার টেবিলে। বিশ্বকাপ আয়োজনে কোনো ত্রুটি নেই বা রাখেওনি। কঠোর নিরাপত্তা দেয়ার কারণে- ঢাকা, মিরপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, সাগরিকার এলাকার লোকজন যে কী ভোগান্তিটা পুইয়েছেন, তা যারা নিজ চোখে দেখছেন তারাই কেবল অনুভব করেছেন। নিরাপত্তার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তা বন্ধ। মুমূর্ষু রোগী নিয়েও রোদের মধ্যে রাস্তায় চলতে পারেননি। অসুস্থ, বয়স্ক বা শিশুদের নিয়ে যাত্রীবাহী পরিবহনে কী ভোগান্তি ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। কারণ শুধু একটিই-বিশ্বকাপ যাতে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হয়। সে ত্যাগ স্বীকার করেছেন ঢাকাবাসী। বিশ্বের অন্যকোনো দেশ হলে এমনটা করতে পারত কি না সন্দেহ। কারণ নাগরিক অধিকার বলে একটি কথা আছে। চাইলেই সে অধিকার হরণের সাধ্য নেই কারোরই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা করবেন, দায়িত্ব পালন করার জন্য। প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বাংলাদেশ বলেই চোখবুঝে সহ্য করছে সবাই। একে উদারতাও বলা যাবে। কিন্তু জনগণের ওই ত্যাগ ও তিতীক্ষার প্রতিফলন কী? রাজ কোষাগার থেকে কোটি টাকা খরচ তা না হয় বাদই দেয়া হলো। কী পেল বাংলাদেশ, এ হিসাব মেলাবে না কেউ? অবশ্যই। মেলাতে তো হবেই। মুখে ব্যর্থ বা পারি না বলেই যেমন পার হওয়া যায় না। তেমনি আসলেই কী বিসিবি বিশ্বকাপের বিশ্বসেরাদের সাথে লড়াই করার জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলেছিলেন টিম বাংলাদেশকে? প্রশ্নগুলো চলেই আসছে। সুপার টেনের নেদারল্যান্ডসসহ প্রতিটি দলই অনেক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে বিশ্বকাপের এ মঞ্চে। বাংলাদেশ এবার তার ধারকাছ দিয়েও যায়নি। কী ছিল টিম বাংলাদেশে, খুঁজলে পাওয়া যাবেÑ শূন্যতা আর শূন্যতা। সামান্য জিম্বাবুয়ে বা নেপাল বা কেনিয়ার সাথে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে বা নর্মাল কোনো ম্যাচ বা টুর্নামেন্ট খেলতে যে স্টাফ বিদ্যমান, বিশ্বকাপের মতাে আসরেও ওই টিম স্টাফ নিয়েই ছিল বাংলাদেশ। এতটা ক্যাজুয়াল একটা দল হয় কি করে। এতটা উদাসীনও হলো কিভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সে প্রশ্নই চলে আসছে। প্রতি ক্রিকেট দলেই ছিল একাধিক কোচ, কর্মকর্তা। স্পেশাল পেস বা স্পিন বোলিং, ফিল্ডিং অ্যাডভাইজার। এর সাথে দলের হেড কোচ তো আছেনই। বিশ্বসেরা আসরে লড়তে এগুলো তো লাগবেই। পাকিস্তানের টেন্টে সারাক্ষণই বসে থাকতে দেখা গেছে ক্রিকেট লিজেন্ড জহির আব্বাসের মতো ক্রিকেটারকে। শোয়েব আকতার, ওয়াসিম আকরাম, রমিজ রাজারা তো আছেনই। ভারতীয় দলের সাথে মূল স্টাফের পাশাপাশি, রবি শাস্ত্রী, সৌরভ গাঙ্গুলী, গাভাস্কার, কপিল দেবের মতো ক্রিকেটার। অস্ট্রেলিয়া দলের কাছাকাছিতে শেন ওয়ার্ন, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্টইন্ডিজ থেকে শুরু করে প্রতিটি বড় দলের আশপাশেই থাকতে দেখা গেছে সে দেশের গ্রেটদের। যদিও তাদের সবাই দলের সাথে আসেনি। এসেছেন স্টার স্পোর্টসের হয়ে ধারাভাষ্য বা অন্যকোনো উপায়ে। কিন্তু নিজ দেশের জাতীয় পতাকা ওপরে তুলে ধরতে যখন যার যা প্রয়োজন, দলকে তারা সহায়তা দিয়ে আসছেন। দেখতেও যা ভালো লাগে।
অথচ হোমে টিম বাংলাদেশ ছিল একেবারেই ‘এতিম’। এক হেড কোচ শেন জার্গেনসেন ছাড়া দলের সাথে নেই আর কেউই। তিন নির্বাচক দূর থেকে উঁকি, ঝুঁকি দিতেন ব্যাস এটুকুই। আগের বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে স্পিন স্পেশালিস্ট সাকলান মোশতাককে নেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ওই আসরকে ঘিরে কিছু ম্যাচও খেলা হয়েছিল প্রস্তুতির জন্যই। যার সুফলও পাওয়া গেছে। তা ছাড়া সাকলানের বদৌলতে দলের স্পিনারদের অনেক উপকারও হয়েছে। নিজ মাটিতে ভালো একজন স্পিন স্পেশালিস্ট থাকলে এত ভোগান্তিতে তারা হয়তো পড়তেন না। বিশেষ করে যে উইকেটে স্পিনেরই জয়জয়কার। অথচ সোহাগ গাজী, সাকিবরা যখন কাক্সিত ফল পাচ্ছিলেন না। নতুন নতুন টেকনিকের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ প্রস্তুতিটা নিয়ে এসেছেন বলে। এখানে স্পেশালিস্ট থাকলে পারতেন কৌশল বাদলে দ্রুত নতুন কৌশল শিখিয়ে দিতে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান, স্পিন কিংবা পেসাররা ছিলেন অসহায়। বিশ্বের সেরাদের মোকাবেলা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নতুন কৌশল পাবেন কই। ফলে ভেঙে পড়েছেন তারা ক্রমেই মানসিকভাবে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু উত্তরণের পরিবর্তে পেয়েছেন শুধু ভর্ৎসনা! আর তা বিসিবির কাছ থেকেই বেশি। দলে নেই একজন ব্যাটিং কোচও। জার্গেনসেন একজন পেস বোলিং কোচ হিসেবেই দলে অন্তর্ভুক্ত হন। ভালো কোচ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয় মূল কোচের। বাংলাদেশ দল দিয়েই যার সূচনা মূল কোচের কাজ, তার কাছ থেকে এত বিশাল আসরে ভালো কিছু আশা করা যায় কিভাবে। রাত পোহালেই ভিন্ন টাইপের দলের মোকাবেলা যেখানে। অত আইডিয়াই বা তিনি কোথায় পাবেন উপমহাদেশের এ কন্ডিশনে একজন অস্ট্রেলিয়ান হয়ে। যখন দলীয় কর্তাদের প্রশ্ন করা হতো, তখন শুধু নাই আর নাই ছাড়া আর কোনো উত্তর আসত না। ছিল না প্রেস হ্যান্ডেল করার জন্য একজন মিডিয়া ম্যানেজারও। সব দেশের তা থাকলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাজ সেরে দিত আইসিসির লোকজন। যারা শিরোপা জিততে এসেছেন তারা তো বিশ্বের সেরা সব তারকা। তাদের জন্য স্পেশাল কোচ থাকতে পারে প্রতি ডিপার্টমেন্টে, তাহলে টিম বাংলাদেশের জন্য কেন ছিল না? নিজ দেশে অনুষ্ঠিত প্রেস্টিজিয়াস এ টুর্নামেন্টে কেন এ কৃপণতা। দলের ম্যানেজার তিনিও একজন প্রশাসকও। আকরাম খান দায়িত্ব পালন করেন ম্যানেজারের। অথচ তিনি হলেন ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও ক্রিকেট অপারেসন্সের পরিচালক। সব ক্রিকেটারদের যাবতীয় বিষয়ে হিসাব-নিকেশ, ভালো-মন্দ দেখা থেকে শুরু করে সব কৈফিয়ত তলব করার অধিকার রাখেন তিনি। এত পাওয়ারফুল একজনকে কেন ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়দের সাথে সারাক্ষণ মিলেমিশে থাকার দায়িত্বটা দেয়া হলো। এক ম্যাচ শেষে যতটুকু সময় পাওয়া যায় অনুশীলনে। সেখানে এক হেড কোচ ক’দিকেই বা মনোযাগ দিতে পারেন। তিনিও তো একজন মানুষ। যেখানে প্রতি ডিপার্টমেন্টই প্রতিনিয়ত পড়ছে প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জের মুখে। সেখানে জার্গেনসন দলের ১৫ ক্রিকেটারের কোন দিকটা দেখবেন প্রতি দিনের দুই-তিন ঘণ্টার অনুশীলনে। বেশি কোচ থাকলে ভাগ করে দায়িত্ব দেয়া হতো। আগে যেমন দেখা গেছে। কিন্তু বিশ্বকাপের এ আসরে একা সব সামলাতে হয়েছে। দোষ কার? হেড কোচের। না ক্রিকেটারের। যে সাকলানকে বাংলাদেশ রাখল না স্পেশাল কোচ হিসেবে। তাকে ওয়েস্টইন্ডিজ নিয়ে কী সাফল্যটা পেল তা পাকিস্তান, ওয়েস্টইন্ডিজ খেলার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বাংলাদেশের তো আরো বেশি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কই, সে আয়োজন। ব্যাটিং নিয়ে যে হতাশা একজন ব্যাটিং স্পেশালিস্ট কোচ আর কবে নেয়া হবে দলে? শত কোটি টাকা খরচা করতে সমস্যা নেই। অথচ যেখানে অর্থ খরচের প্রয়োজন সেখানেই বিসিবি নির্বিকার বা বুঝতেই চান না। আর চাইবেনই বা কিভাবে।
অযোগ্য, অদক্ষ লোকবল নিয়ে বোর্ড। তাদের কাছ থেকে ভালো ফল আশা করা যায় কিভাবে? যার খেসারত পদে পদে গুনতে হয় দেশ, জাতি এমনকি সাধারণ মানুষকে। তা কি ভাবার সময় রয়েছে কারো?