জনগণ যখন সরকারকে ভয় পায় তখন তা ভয়ঙ্কর হয়॥ গণতন্ত্রে সরকার জনগণকে ভয় পায়

0
152
Print Friendly, PDF & Email

: ‘রাজনৈতিক ঐক্য ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে প্রধান নিয়ামক’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশিষ্টজনরা অভিযোগ করে বলেছেন, যখন সরকার জনগণকে ভয় পায়, তখন হয় গণতন্ত্র। আর জনগণ যখন সরকারকে ভয় পায় তখন তা হয় ভয়ঙ্কর। তাদের কর্মকা-ে মানুষ হতাশ আর আতংকে থাকে।

তারা বলেন, দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার কারণে কোন প্রতিষ্ঠানই ন্যায়ের উপর থেকে কাজ করতে পারে না। রাজনীতির ক্ষমতার কাছে সবকিছু জিম্মি হয়ে আছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ের কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলে মতামত দেন তারা। আশংকা প্রকাশ করে বলেন, রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? তা ভাবা কঠিন।

গতকাল সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ ২০১৪ উপলক্ষে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা। বিশেষ অতিথি ছিলেন, দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ। এ ছাড়া সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক, এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম, দুদক সচিব মোঃ ফয়জুর রহমান চৌধুরীসহ কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল সেমিনারের সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করেন।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা বলেছেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় যোগ্য লোক নিয়োগ না দেওয়ায় আমরা নিরাশ হচ্ছি। আইন আছে, তবে প্রশ্নটা হচ্ছে আইন সঠিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে কি না? রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা ভাবা কঠিন।

আবু হেনা বলেন, দলীয় শৃঙ্খলে থাকার কারণে কোন প্রতিষ্ঠানই ন্যায়ের উপর থেকে কাজ করতে পারে না। রাজনীতির ক্ষমতার কাছে সবকিছু জিম্মি হয়ে আছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ের কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা আমাদের দেশের সকল প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনীতিবিদরা সঠিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী না হলে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সাবেক এই সিইসি বলেন, দুদক আসলে আইন দিয়ে তৈরি একটি প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ এবং দুদককে শক্তিশালী করতে প্রতিষ্ঠানটির সাংবিধানিক রূপ দিতে হবে। সেই সাথে কোনো প্রভাব ছাড়াই যেন কাজ করতে পারে সেই স্বাধীনতা দিতে হবে বলে জানান তিনি।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. ওসমান ফারুক বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সব সময়ই বিরোধী দলের ও ক্ষমতাহীন লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এখন সরকারি যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে তারা সবাই সরকারের আশীর্বাদের বাহিরে বলে মন্তব্য করেন  তিনি।

ড. ওসমান ফারুক বলেন, সরকারি সবগুলো প্রতিষ্ঠানই দলীয় তোষামদে ব্যস্ত। প্রশাসনের সকল স্তরে দলীয় প্রভাবের কারণে মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।

তিনি বলেন,সরকারকে খুশি করতে গিয়ে সরকারি সব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে হবে। প্রয়োজনে সততার প্রশ্নে টিকে থাকতে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, দুর্নীতির জন্য সব সময় রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনকে দায়ী করা হয়। তবে আমাদের দেশের প্রাইভেট সেক্টরগুলো রাজনীতিবিদদের চেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার দুর্নীতি লুকাতে অনেক সময় রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে দলীয়করণ হয়ে গেছে। সরকার যেভাবে কাজ করতে বলছে প্রশাসন সেভাবে কাজ করছে নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি-পদাবনতি এ সব প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিয়ম অনুসারে না হলে প্রশাসন কখনো দলীয়করণমুক্ত হতে পারবে না।

দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, দুদকের প্রতি জনসাধারণের হতাশায় আমরা হতাশ নই। এই হতাশা একদিনের নয়, বহুদিন ধরেই এ হতাশার সঞ্চয় হয়েছে। ১৯৮৭ সাল থেকে এ হতাশার সৃষ্টি। তখন ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো। এখন তা কমিশনে পরিণত হলেও হাতাশা কাটেনি। সরকারের উদ্যোগে নয়, আমরা নিজেদের উদ্যোগেই হলফনামার সম্পদের হিসাব নেওয়া শুরু করেছি।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, সমাজে ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই। কমিশনের শক্তিও সীমিত।

সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে হলফনামা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তা চরিত্র হনননামায় পরিণত হয়েছে।

পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিটি মানুষের জন্য সু-শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

সিপিবি’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বর্তমানে দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে, সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথায়? এমন অবস্থা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে আর কোনো ঐক্য না থাকলেও একটি বিষয়ে ঐক্য আছে, তা হলো লুটপাটের ঐক্য। এর কারণ হলো, তারা দুর্নীতিবাজদের কাছে জিম্মি।

এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হক বলেন, সাধারণ মানুষের ধারণা সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অনুসন্ধান চলছে তা থেকে তারা হয়তো রেহাই পেয়ে যাবেন।

তিনি বলেন, দেশে দুর্নীতির আশ্রয় দিয়েছে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন এখন ক্ষমতা ও টাকার লোভে। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষ ধারণা করছে তারা পার পেয়ে যাবেন। মানুষের সে ধারণাকে পাল্টাতে হবে।

শেয়ার করুন