যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্বিতীয় মামলার কার্যক্রমও(জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী) শেষ পর্যায়ে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চলতি মাসেই এ মামলার আপিল শুনানি শেষ হতে পারে।
মঙ্গলবার আপিল মামলাটির শুনানির ৪৪তম দিনে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি সাঈদীর বিরুদ্ধে ১০ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে সময়ের আবেদন জানান। পরে আগামী ৮ এপ্রিল পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন আপিল বিভাগ।
ইতোমধ্যে আসামিপক্ষ তাদের শুনানি ও যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষ করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষও আর সর্বোচ্চ ৭ দিন শুনানি করবেন বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের শুনানির জবাব দিতে পারবেন আসামিপক্ষ। সব মিলিয়ে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ মামলার শুনানি শেষ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ মার্চ সাঈদী ও সরকারপক্ষ পৃথক দু’টি আপিল (আপিল নম্বর: ৩৯ ও ৪০) দাখিল করেন। এরপর গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে আপিল শুনানি শুরু হয়। এ পর্যন্ত মোট ৪৪ দিন শুনানি হয়েছে। ইতোমধ্যে আসামিপক্ষ শুনানি ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের শুনানি হয়তো আর সাত দিন করতে হবে। এরপর চাইলে আসামিপক্ষ আমাদের বক্তব্যের জবাব দিতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আসামিপক্ষের জবাবের পর প্রয়োজনে রাষ্ট্রপক্ষও বক্তব্য দিতে পারবেন। এরপর রায়ের জন্য আপিল মামলাটি অপেক্ষমাণ রাখবেন আপিল বিভাগ। যেমনটি করা হয়েছিলো আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে।
গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া শুনানিতে প্রথমে শেষ হয় সাঈদীর করা আপিল আবেদনের শুনানি। সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট এএসএম শাহজাহান এতে অংশ নেন। ট্রাইব্যুনালের ১২০ পৃষ্ঠা রায় পড়ে শোনানো শেষে তারা রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের সাক্ষ্য ও জেরা পেপারবুক থেকে উপস্থাপন শেষ করেন গত ২১ জানুয়ারি।
এরপর গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অ্যাডভোকেট এএসএম শাহজাহান সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
প্রধান বিচারপতি মো. মোজ্জাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চে এ শুনানি চলছে। অন্য ৪ বিচারপতি হচ্ছেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণের মতো আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় দু’টি অপরাধে সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠন করা অভিযোগে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১শ’ থেকে ১শ’৫০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার মত ২০টি ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছিলো।
এগুলোর মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। এর মধ্যে দু’টি অভিযোগে অর্থাৎ ৮ ও ১০ নং অপরাধে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এছাড়া ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯ নং অভিযোগ প্রমাণিত হলেও এগুলোতে কোনো সাজার কথা ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল জানান, দুই অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় বাকিগুলোতে আর সাজা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর বাকি ১২টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলোতেও কোনো সাজা ঘোষণা করা হয়নি।
সাজা ঘোষিত না হওয়া ওই ৬টি অভিযোগে শাস্তির আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আর সাঈদীর ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ আপিল করেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর বিধান অনুসারে, রায় ঘোষণার এক মাসের মধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করা যাবে। সে হিসেবে গত বছরের ২৮ মার্চ আপিলের শেষ দিনটিতেই উভয়পক্ষ আপিল আবেদন করেন।