লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাচন কাল। আর গতকাল সেখানে কয়েকটি এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিয়েছেন তাহের বাহিনীর সদস্যরা। এই সশস্ত্র মহড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখেছে। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ছেলে এ কে এম সালাহউদ্দিন ওরফে টিপুকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী করে আনতে মরিয়া লক্ষ্মীপুরের বহুল আলোচিত পৌর মেয়র আবু তাহের। সে জন্য ‘তাহের স্টাইলে’ সবই করছেন তিনি। অনুরোধ, জোর খাটানো, হুমকি-ধমকি, অর্থব্যয়, তদবির—সব তরিকার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছেন তিনি।
৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছেলে সালাহউদ্দিন টিপুকে প্রার্থী করেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনে। কিন্তু মনোনয়ন বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। পরে স্ত্রী নাজমা তাহেরকে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংরক্ষিত নারী আসনে সাংসদ নির্বাচিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ব্যর্থ হন তিনি। কিন্তু কাল আর ব্যর্থ হতে রাজি নন তাহের। ছেলের একাধিক নির্বাচনী সভায় আবু তাহের বলেছেন, ‘টিপু বিজয়ী না হলে আমি বাঁচব না।’
তবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের অনেকে মনে করেন, ছেলেকে উপজেলায় বসিয়ে জেলায় তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করতে এ নির্বাচনে তাহের এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি এখন দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে থাকলেও এ নির্বাচনে ছেলে সালাহউদ্দিনের পক্ষে আওয়ামী লীগের সমর্থন আদায় করতে বেগ পেতে হয়নি। তাহের জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আর, সালাহউদ্দিন জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। পরিবারটি প্রায় সবার বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসের নানা অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে গতকাল নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনেও প্রচারে থাকতে পারেননি বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল শনিবারও উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন ও পৌর সদরের প্রতিটি ওয়ার্ডেই মোটরসাইকেল মহড়া দিয়েছেন তাহের বাহিনীর সদস্যরা। কয়েকটি এলাকায় এই মহড়া ছিল সশস্ত্র। তাঁদের হুমকি-ধমকির মুখে বিএনপিসহ অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী মহিউদ্দিন বকুল অভিযোগ করেন, শাকচর ইউনিয়নে ও ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নে তাঁর নেতা-কর্মীদের মারধর করে তাঁদের কাছ থেকে পোস্টার ও এজেন্ট কার্ড ছিনিয়ে নিয়েছে তাহেরের ছোট ছেলে শিবলুর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা।
গতকাল রাত ১০টায় বাঙ্গা ইউনিয়নের যুবদল কর্মী আবুল কাশেমকে তাঁর বাড়ির সামনে মারধর করে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। মধ্যরাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার শেখ শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ খবর পেয়ে কাশেমকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ চেষ্টা করছে।
এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় ভবানীগঞ্জে ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সহসভাপতি আবুল কাশেমকে মারধর করে রাস্তায় ফেলে যায় সন্ত্রাসীরা।
এ ছাড়া শুক্রবার রাতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মাহমুদুল হকের নিজ ইউনিয়ন মান্দারি এলাকায় ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। রাতভর তারা সেখানে টহল দিয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, তাঁদের কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়া আর আতঙ্ক তৈরি করতে এই অভিযান চালানো হয়েছে।
বিএনপির জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিবুর রহমান জানান, গতকাল দত্তপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির ৬৭ জন নেতা-কর্মীর ও উত্তর জয়পুরে ৭২ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দেওয়া হয়েছে সদর থানায়। ভোটের দিন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর সম্ভাব্য এজেন্ট ও সক্রিয় কর্মীদের মূলত এ দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। তাই এ দুটি ইউনিয়নে ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে তিনি দাবি করেন।
দিনভর গুজব: গতকাল দিনভর নানা গুজবে মুখর ছিল লক্ষ্মীপুর। সকাল থেকেই পুরো শহরে কানাঘুষা শুরু হয়, বিএনপির নেতা ও আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলাসহ কয়েকটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আবু তাহেরের বড় ছেলে এ এইচ এম বিপ্লব ছাড়া পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রাজনৈতিক কর্মী বলেন, আতঙ্ক তৈরির জন্যই এ গুজব ছড়ানো হয়েছে। কারণ ‘খুনি’ হিসেবে এলাকায় বিপ্লবের কুখ্যাতি আছে।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী মহিউদ্দিন অভিযোগ করেন, বিপ্লব লক্ষ্মীপুর কারাগারে বসেই মুঠোফোনে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন সবাইকে।
প্রথম আলো গায়েব: গতকাল লক্ষ্মীপুরের পাঠকেরা প্রথম আলো পাননি। সকালেই গায়েব হয়ে যায় সব পত্রিকা। ‘লক্ষ্মীপুরে জান বাঁচানো ফরজ’ শিরোনামে গতকাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সরেজমিনে ওই প্রতিবেদনে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুরে তাহের বাহিনীর নানা কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। সকালে জেলায় পত্রিকা আসার পরপরই হকার ও এজেন্টদের কাছ থেকে সব পত্রিকা কিনে নিয়ে যান তাহের বাহিনীর সদস্যরা। পরে অনলাইনে প্রতিবেদনটি পড়ে লক্ষ্মীপুরের অনেকেই আশপাশের এলাকা থেকে পত্রিকা কিনে নিয়ে আসেন।