নিখোঁজদের উদ্ধারে আগ্রহ নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর

0
149
Print Friendly, PDF & Email

নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে আগ্রহ নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। প্রতিটি ঘটনাতেই থানায় মামলা অথবা সাধারণ ডায়েরি হচ্ছে। কিন্তু পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এসব ব্যক্তিকে উদ্ধারে কোনো মাথাব্যথা নেই। উল্টো কোথাও কোথাও নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারকেই হয়রানির অভিযোগ মিলছে। অন্য দিকে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার নয়া দিগন্তকে বলেছেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশ সেই দায়িত্ব পালন করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারা দেশে একের পর এক নিখোঁজের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতাকর্মী। কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা তাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন এই পরিবারগুলো অপেক্ষা করছে তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনকে ফিরে পেতে। অনেক পরিবার দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তারা কান্ত। কিন্তু নিখোঁজ স্বজনের কোনো হদিস পাচ্ছেন না।
গত ২৭ নভেম্বর রাতে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপি সভাপতি লাকসাম বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও লাকসামের সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু এবং লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজকে কালো পোশাকধারী লোকজন তুলে নিয়ে যায়।
গত ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখানের প্রেমবাগান এলাকা থেকে অপহৃত হন ছাত্রদল নেতা নিজাম উদ্দিন মুন্না (২৪)। একদল অস্ত্রধারী নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে মুন্নাকে অপহরণ করে। মুন্নার সাথে ঝিন্টু নামে এক যুবককেও অপহরণ করা হয়। মুন্নার বাবা সামছুদ্দিন জানান, তার ছেলের অপহরণের পর দ্বারে দ্বারে ঘুরে তিনি এখন কান্ত। সাড়ে তিন মাস পার হলেও তার ছেলের কোনো সন্ধান মেলাতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন কোনো দফতর নেই, যেখানে তিনি যাননি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ তো হয়ইনি, উল্টো হয়রানি ও নাজেহাল হয়েছেন।
রাজধানীর বংশালের হাজী আবদুল্লাহ সরকার লেনের বাসিন্দা জহির নিখোঁজ হয়েছেন। জহির স্থানীয় ছাত্রদলের নেতা ছিলেন বলে জানা গেছে। গত ২ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার সূত্রাপুর ও বংশাল থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ ছাত্রদল কোতোয়ালি থানার সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান সেন্টু, বংশাল থানার সহসভাপতি সোহেল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি মো: জহির ও সাধারণ সম্পাদক মো: পারভেজ, ৭২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সহসভাপতি ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের সদস্য সাব্বির, বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য মো: চঞ্চল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য মো: কালু, ৭০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাফরান হোসেন উজ্জ্বল এবং ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি ও বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য মো: সোহেলকে ধরে নেয়া হয়। এদের মধ্যে ৭০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাফরান হোসেন উজ্জ্বল এবং ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি ও বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য মো: সোহেলকে শাহবাগে গাড়িতে আগুনের মামলায় শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জহিরসহ বাকিদের খোঁজ নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
গত ২৮ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি আনিসুর রহমান ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো: বিপ্লব এবং ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মিঠুকে উঠিয়ে নেয়া হয়। গত ৪ ডিসেম্বর গুলশানের আমেরিকান দূতাবাসের সামনে থেকে র‌্যাব পরিচয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রদল কর্মীকে আটক করা হয়। এখন পর্যন্ত তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আটক ছাত্রদলকর্মীরা হলেনÑ আসাদুজ্জামান রানা, মাযহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় পাঠাগার সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জিয়াউর রহমান গত ৫ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন।
২০১২ সালের ২৬ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের বোড়াশী পশ্চিমপাড়ার মান্দারতলা এলাকা থেকে অপহৃত হন উবায়দুর নামে এক তরুণ। একই দিন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার দক্ষিণ ফুকরার মিল্টন বাজার এলাকা থেকে অপহৃত হন মাহবুব নামে অরেক তরুণ। এভাবে নিখোঁজ রয়েছেনÑ আওয়ামী লীগ নেতা নুর মোহাম্মদ হাজী, তার জামাতা নজরুল ইসলাম বাছা, ব্যবসায়ী হুমায়ুন, মাওলানা শামীম, ওয়ালি উল্লাহ, ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার, শ্রমিক হাবিবুর রহমান, ব্যবসায়ী আব্দুল করিম হাওলাদার। নিখোঁজ হয়েছেন রাজধানীর মিরপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কালাম শেখ, তার মামাতো ভাই আবুল বাশার শেখ, আব্দুল করিম ও আতাউর রহমান ওরফে ইস্রাফিল, পুরান ঢাকা থেকে ব্যবসায়ী রেজাউল করিম রিজভি, সূত্রাপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী তারিব উদ্দিন আহম্মেদ, শাহজাহানপুর থেকে দোকান কর্মচারী রফিকুল ইসলাম, জিন্দাবাহার লেন এলাকা থেকে ব্যবসায়ী আয়নাল মোল্লা, কামরাঙ্গীরচর আবদুল আজিজ লেনের বাসিন্দা সুলতান হাওলাদার, রাজধানীর দক্ষিণ খান থেকে ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম, ফকিরেরপুলের হোটেল অবসরের সামনে থেকে ফেনীর সারোয়ার জাহান বাবুল, রাজধানীর সূত্রাপুর থেকে ব্যবসায়ী মমিন হোসেন, রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ভাটাপা জামে মসজিদের ইমাম ও গোদাগাড়ী পালপুর ধরমপুর মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক আমিনুল ইসলাম, মালীবাগ থেকে অপহরণ করা হয় ভোলার আরিফ, জসিম, জুয়েল, শেখ সাদী, দিদার, আকাশ ও মিরাজ, হাতিরপুল এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্য সেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান সোহেল, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে আল আমিন ও সদস্য মাসুম হোসেন। ১০ দিন পর মুন্সীগঞ্জ থেকে উদ্ধার হয় ইসমাইলের গলিত লাশ। ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী তাবির উদ্দিন আহম্মেদ রানা। রাজধানীর গেণ্ডারিয়া এলাকা থেকে নিখোঁজ হন তপন দাস। ৯৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তুষার ইসলাম টিটু, ফার্মগেটের ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী সুজন, ব্যবসায়ী জহির রায়হান হিরণ, ব্যবসায়ী হাজী ওয়াজি উল্লাহ, সিদ্ধিরগঞ্জের সানাপাড়ের ইউনুস মুন্সী, তার মামাতো ভাই শেখেন মাতবর, তাদের সঙ্গী হাফিজুল ইসলাম স্বপন, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার মোজাফফর, ব্যবসায়ী শহীদুর রহমান, রাজধানীর সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো: মাসুদ, যাত্রাবাড়ীর গোলাম মুর্তাজা, বরিশালের করিম কুঠির এলাকার আলী হায়দার, বরিশালের জাগুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ওয়ার্ড বিএনপির সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন, বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি গোলাম মোস্তফা নান্না, ফরিদপুরের নগরকান্দার সোবহান এবং গাইবান্ধার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানসহ অনেকেই নিখোঁজ হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব ঘটনায় থানায় মামলা বা সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। কিন্তু তাদের উদ্ধারে কোনো তৎপরতা নেই বলে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা-মানবাধিকারের নির্বাহী পরিচালক আবুল বাসার নয়া দিগন্তকে বলেন, একজন মানুষও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হলে তার দায়িত্ব সরকারের। যারা নিখোঁজ হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের সদস্য। এ কারণে এই ঘটনার সাথে জড়িত বলে সরকার ও সরকারি বাহিনীর প্রতিই দোষ পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সরকারেরই উচিত কারা এর সাথে জড়িত তা খুঁজে বের করা এবং নিখোঁজদের উদ্ধার করা। তিনি বলেন, কোনো নিখোঁজের ঘটনা ক্রসফায়ারের চেয়েও জঘন্য। পরিবার বুঝতেই পারছে না, কারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কারা বিচার করছে। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের।
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার নয়া দিগন্তকে বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার করার দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশ সেই দায়িত্ব পালন করে আসছে। অতীতেও করেছে, বর্তমানেও করছে। যেখানে যেভাবে প্রয়োজন, সেখানে সেভাবেই দায়িত্ব পালন করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

শেয়ার করুন