দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে ‘নিখোঁজ’ হওয়া বিএনপির সেই নেতাদের সন্ধান মেলেনি এখনো। বিএনপির দাবি, নির্বাচনের পূর্বাপর তিন মাসে অন্তত ৬০ জন নেতা-কর্মী ‘গুম’ হয়েছেন। এ নিয়ে দলটির পক্ষ থেকে একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। নিখোঁজ নেতা-কর্মীদের পরিবারের অভিযোগ, সাদা পোশাকে ‘ডিবি’ কিংবা ‘র্যাব’ পরিচয়ে অধিকাংশ নেতা-কর্মীকেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো সন্ধান দিতে পারেননি। এ নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো। ‘গুম আতঙ্ক’ বিরাজ করছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও।
প্রায় দুই বছর ধরে নিখোঁজ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী এবং এরও অনেক আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম। এখনো তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এখনো তাদের ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন এ দুই পরিবারের সদস্যরা। প্রথম দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা দেখা গেলেও এখন থেমে গেছে সব।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল জিয়াউল আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যে কোনো অভিযোগ আসলে খতিয়ে দেখা হয়। গুমের অভিযোগ আসলে অবশ্যই তা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়। যেসব অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার বাংলাদেশের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে চরম ব্যর্থ। গুম, খুন হচ্ছে। যেখানে-সেখানে পাওয়া যাচ্ছে লাশ। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি দলের ‘সন্ত্রাসী’ আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের ‘বিভিন্ন সংস্থা’ এসব ঘটনায় জড়িত। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহল এ নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন। আন্দোলন থেকে সরাতেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের এ ধরনের ন্যক্কারজনক পথ বেছে নিয়েছে সরকার। যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত অবশ্যই তাদের একদিন বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে। গেল বছরের ২৭ নভেম্বর নিখোঁজ হন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু এবং পৌর বিএনপি সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ। চার মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পর্যন্ত মেলেনি তাদের হদিস। নিখোঁজ পরিবারের আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মীরা এখনো ওই দুই নেতার ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। পরিবারের দাবি, গেল বছরের ২৭ নভেম্বর ঢাকা থেকে কুমিল্লায় অ্যাম্বুলেন্সে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজ। তারা ফিরে আসবেন এ আশায় এখনো অপেক্ষায় আছেন নিখোঁজ ওই দুই নেতার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মীরা। তাদের অভিযোগ, ২৭ নভেম্বর অ্যাম্বুলেন্সযোগে কুমিল্লা যাওয়ার সময় র্যা পরিচয়ে তাদের আটক করা হয়। অবশ্য ঘটনার শুরু থেকেই র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের আটকের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। দুই নেতা নিখোঁজের পর থেকে বিএনপিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ উপজেলায় লাগাতার হরতাল, সভা-সমাবেশ, থানায় সাধারণ ডায়েরি, প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশের আইজি বরাবর স্মারকলিপিসহ কর্মসূচি পালন করেছে।
সাইফুল ইসলাম হিরুর ছেলে রাফসান বলেন, ‘আমার বাবাকে র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ চার মাস পার হলেও বাবার কোনো খোঁজ মেলেনি। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমার বাবাকে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করছি।’ হুমায়ুন কবির পারভেজের সহধর্মিণী শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘ছোট মেয়ে মাইশা বারবার জানতে চায়, তার বাবা কোথায় গেছেন? এতদিন হলো এখনো আসছেন না কেন? মেয়ের এসব প্রশ্ন এবং কান্না দেখে নিজেকে সামলাতে পারছি না।’ এ প্রসঙ্গে লাকসাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে পারভেজের ভাই গোলাম ফারুক বাদী হয়ে লাকসাম থানায় একটি জিডি করেছেন। ওই দুই ব্যক্তির সন্ধানে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপির তালিকা অনুযায়ী গুম হওয়া অন্যান্য নেতা-কর্মী হলেন, নীলফামারীর আশরাফ আলী, আবদুর রহমান, বাবুল হোসেন, আজিজুল ইসলাম, ছকিন উদ্দিন মেম্বার, মহিদুল ইসলাম, আবদুল মালেক কাজী, আবদুল মালেক ও রাহেদুল ইসলাম দোলন; গাইবান্ধার নাজমুল হাসান শাকিব, মতিয়ার পারভেজ, মুসা আহম্মেদ, শাখাওয়াত, নুরুন্নবী, নবীন মিয়া, ঝিনাইদহের নজরুল ইসলাম ও নাসির উদ্দিন; খুলনার ইসলাম; সাতক্ষীরার কাজী হাসান উদ্দিন, হাফেজ কাজী হেলাল উদ্দিন, হাফেজ কাজী আরাফাত, আনোয়ারুল হক ও আনু হানিফ ছুটন মিয়া; সিলেটের ইফতেখার আহম্মেদ দীনার, জুনেদ আহম্মেদ ও আনসার আলী; লক্ষ্মীপুরে ইকবাল হোসেন জুয়েল, বেলাল হোসেন, আলমগীর হোসেন, রাজু, ওমর ফারুক ও আবদুল কাদের। ঢাকা মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল নেতা খালিদ হোসেন সোহেল, সবুজবাগ থানার ছাত্রদল সভাপতি মাহবুবুল হক সুজন, ২৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি ফরহাদ হোসেন, লিটন, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-সম্পাদক তরিকুল ইসলাম জন্টু, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা আসাদুজ্জামান রানা, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আল আমিন, জিয়াউর রহমান শাহীন, সোহেল, রানা, তানভীর, পারভেজ, আবুল হালিম, জসিম, মো. সোহেল, কাশেম প্রমুখ।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘তিন মাসে ঢাকায় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের ২২ জন নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যসহ আমরা শেষ চেষ্টা চালিয়েও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে গুম হওয়া রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করা হলেও তারা দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, সন্দেহের তীর সরকারের দিকে।’ ডিবি, র্যাব পরিচয়ে অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে তুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিএনপির তালিকায় বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে পুলিশ, যৌথবাহিনী, র্যাব এবং আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাসীদের’ গুলিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের ২৬১ জন নেতা-কর্মী নিহত এবং গুম হয়েছেন ৬০ জন। তালিকার একটি কপি বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে রয়েছে। তালিকায় দেখা গেছে, গুমের সংখ্যা ঢাকা মহানগরীতে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে সবই বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। গুম হওয়াদের মধ্যে ১৫ জনই ছাত্রদলের। তবে মহানগরীতে নিহতের সংখ্যা এক। তালিকায় মহানগরীর বাইরে নিহতদের নাম ও পিতার নাম উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখ রয়েছে নিহতদের অনেকের পদ-পদবিও। তবে কারও কারও নামের পাশে পদবি বা তারা কোন অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের তা উল্লেখ নেই। কারও নামের সঙ্গে ঠিকানা ও ঘটনাস্থল উল্লেখ আছে। আবার কোথাও শুধু নাম ছাড়া আর কিছুই উল্লেখ নে