আর মাত্র দুই দিন পরে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার নির্বাচন। কিন্তু সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে আর কোনো প্রার্থীর পক্ষে কোথাও কোনো প্রচার বা পোস্টার নেই। সর্বত্র চাপা আতঙ্ক, কে কখন সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার বা গ্রেপ্তার হন।
জীবন বাঁচাতে বা গ্রেপ্তার এড়াতে এখানকার অগণিত রাজনৈতিক কর্মী এখন এলাকাছাড়া। সরকারি দলের প্রার্থীর সমর্থকদের বাইরে আর যাঁরা এলাকায় আছেন, তাঁরাও অনেকটা বোবা। নির্বাচন নিয়ে কেউ কথা বলছেন না।
গতকাল শুক্রবার লক্ষ্মীপুর শহরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অনেকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। সবারই এক কথা, ‘জান বাঁচানো ফরজ’। ভোটে কে জিতল, কে হারল—এ নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
সর্বত্র এই ভীতি ও আতঙ্কের কারণ লক্ষ্মীপুরের কথিত গডফাদার ও পৌর মেয়র আবু তাহের। তাঁর মেজো ছেলে এ কে এম সালাহ উদ্দিন (টিপু) এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। তাঁকে যেকোনো উপায়েই জেতাতে সক্রিয় তাহের বাহিনী। আর এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনও সহযোগী হিসেবে কাজ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে ভোটকেন্দ্রে কেউ এজেন্ট হতেও রাজি হচ্ছেন না।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ২১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকা নিয়ে সদর উপজেলা। নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিটি ওয়ার্ডেই কথিত তাহের বাহিনীর ২০-৩০ জনের একটি করে দল অবস্থান নিয়েছে। তারা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নজরদারি করছে। তাদের ভয়ে ‘জান বাঁচাতে’ এলাকায় থাকা বিএনপির কর্মীদের কেউ কেউ সালাহ উদ্দিনের পক্ষে কাজ করছেন। বিএনপির এমন কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ‘পরিবারের কারণে এলাকা ছাড়তে পারছি না। কিন্তু এলাকায় থাকতে হলে দোয়াত-কলমের (সালাহ উদ্দিনের নির্বাচনী প্রতীক) পক্ষে কাজ করতে হবে। না হলে জানে বাঁচব না। এখন জান বাঁচানোটা ফরজ, দল পরে।’
লক্ষ্মীপুরে চেয়ারম্যান পদে তাহেরের ছেলে সালাহ উদ্দিন ছাড়াও আরও তিনজন প্রার্থী রয়েছেন। তাঁরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন (মুকুল), একসময়ের আওয়ামী লীগের নেতা ফিরোজ আলম খান ও বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মাহমুদুল করিম (দিপু)।
গতকাল শুক্রবার লক্ষ্মীপুর পৌর সদরের বিভিন্ন এলাকা ও আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে সালাহ উদ্দিন ছাড়া আর কোনো প্রার্থীর পোস্টার বা প্রচারপত্র দেখা যায়নি। কারণ কী, জানতে চাইলে শহরতলির কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ‘নিজেরাই (প্রার্থী) ঘরে থাকতে পারে না। পোস্টার লাগাইব ক্যামনে?’
আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন অভিযোগ করেন, তাহের ও তাঁর ছেলে এলাকা ও এলাকার বাইরে থেকে বিপুলসংখ্যক সন্ত্রাসী জড়ো করেছেন। নির্বাচনী প্রচারের কাজে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মাইক ও গাড়ি ভেঙে দিচ্ছেন। তাঁদের হুমকির মুখে অনেক কর্মী এলাকা ছেড়ে গেছেন।
এই অভিযোগ করেন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মাহমুদুল করিমও। তিনি জানান, হামলা, হুমকি ও পুলিশের অভিযানের মুখে নেতা-কর্মীদের বড় অংশ এলাকাছাড়া। তাই নির্বাচনে এজেন্ট নিয়োগ করা নিয়েও তিনি বিপাকে পড়েছেন।
বিএনপির প্রার্থী মাহমুদুল করিম গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের পুলিশ হয়রানি করছে বলে অভিযোগ করেন। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানির লক্ষ্মীপুরের বাসায় তাঁর উপস্থিতিতে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়। মাহমুদুল করিম অভিযোগ করেন, প্রশাসন কোনো কারণ ছাড়াই তাঁর মালিকানাধীন একটি ইটভাটা গতকাল ভাঙচুর করে বন্ধ করে দিয়েছে। সেখান থেকে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতিকে গ্রেপ্তার করেছে। নির্বাচনের দুই দিন আগে এ ধরনের ঘটনা নির্বাচনী কাজে প্রভাব খাটানোর অপচেষ্টা বলে মনে করেন তিনি।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন তাহেরপুত্র সালাহ উদ্দিন। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, বিএনপির প্রার্থীর লোকজন তাঁর (সালাহ উদ্দিন) নির্বাচনী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগের, কর্মীদের হয়রানি ও হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।
অবশ্য সালাহ উদ্দিনের এই অভিযোগের সমর্থনে কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি, বরং তাঁর সমর্থকেরা গতকাল সন্ধ্যায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিয়েছেন। বশিকপুর বাজারে ২০-২৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে সশস্ত্র তরুণেরা মহড়া দেওয়ার সময় আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ছড়ান। এ সময় তাঁরা জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় কার্যালয়, তাদের পরিচালিত একটি পাঠাগার, একটি মোটরসাইকেল ও একটি সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের অভিযান চলছে। অভিযানের মূল লক্ষ্যবস্তু বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী কোনো এলাকায় সভা করতে গেলে সেখানে হানা দিচ্ছেন তাহের বাহিনীর সদস্যরা। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পরে তাঁদের গত বছর বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় হওয়া বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২৬ মার্চ পৌর সদরের ফারুক প্লাজায় বৈঠক করছিলেন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকেরা। খবর পেয়ে তাহেরের অনুসারী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা সেখানে হামলা চালান। সেখান থেকে বিএনপির প্রার্থীর নয়জন সমর্থককে ধরে মারধর শেষে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এর বাইরে গত কয়েক দিনে লক্ষ্মীপুরের লাহারকান্দি ইউনিয়ন এলাকা থেকে চারজন, ভবানীগঞ্জ থেকে তিনজন, দালালবাজার থেকে একজন, মৌলভীরহাট থেকে একজন, হাজিরপাড়া ও চন্দ্রগঞ্জ থেকে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিবুর রহমান। এঁদের পুরোনো বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তাহের বাহিনীর সন্ত্রাসী কাজে সহায়তা এবং বিএনপির কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুরের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার শেখ শরীফুল ইসলাম দাবি করেন, পুলিশ কাউকে হয়রানি করছে না। তারা কেবল বিভিন্ন মামলায় পলাতক এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী মহিউদ্দিন অভিযোগ করেন, তাঁকেও গ্রেপ্তার করানোর জন্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির একটি মিথ্যা মামলা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাহেরের লোকজন। পরে পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে তিনি নিস্তার পান।
সরকার-সমর্থক প্রার্থীর লোকজনের মহড়া, হুমকি-ধমকি এবং বিএনপির প্রার্থীর লোকজনকে পুলিশি হয়রানির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আচরণবিধি লঙ্ঘনের কিছু অভিযোগ পেয়েছি। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় এবারের নির্বাচনকে একরকম ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হিসেবে নিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের পৌর মেয়র আবু তাহের।
বহুল আলোচিত বিএনপির নেতা ও আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলায় দীর্ঘদিন জেল খেটে ২০০৯ সালে মুক্তি পান আবু তাহের। ২০১১ সালে পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনেও তাঁর বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তির অভিযোগ ছিল। এরপর গত পাঁচ বছরে লক্ষ্মীপুরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন আবু তাহের