কূটনৈতিক চাপে সরকার বিব্রত

0
140
Print Friendly, PDF & Email

রাজনীতি, মানবাধিকার ও শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়ন প্রশ্নে বৈশ্বিক চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার পর এবার ‘কড়া বার্তা’ দিয়ে গেছেন ঢাকা সফর করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের সদস্যরা। নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, বিরোধী রাজনীতিক আর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে প্রায় অভিন্ন ভাষায় কথা বলেছেন তারা। ঢাকা ছাড়ার আগে দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে বেশ কিছু সুপারিশও করেছেন  ইইউ’র সংসদ সদস্যরা। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। গুরুতর অভিযোগগুলোর তদন্তে জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়ে গেছেন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং চলমান উপজেলা নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি ও সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা। তাদের মতে, সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক সংলাপই একমাত্র পথ। ওই সংলাপের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে দুই নেত্রীর সমান দায়িত্ব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। গোলযোগে যে সব উপজেলায় ভোট স্থগিত হয়েছে তার পূর্ণ তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে। নাগরিক সমাজের কাজের সুযোগ এবং মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আইসিটি আইন সংশোধন ও পুলিশের নির্যাতনের ব্যাপারে ন্যূনতম ছাড় না দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিবৃতিতে সরকার ও বিরোধী দলের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর ৪ সদস্যের ইইউ পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দলের প্রথম ঢাকা সফর ছিল এটি। প্রধান বিরোধী জোটসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেনি ইইউ। তাদের পথ অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো। ১৫৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হওয়া এবং বাকি আসনগুলোতে নামমাত্র নির্বাচন হয়েছে। ওই নির্বাচনের ফলের ওপর ভিত্তি করে সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো নতুন নির্বাচনের জন্য অব্যাহতভাবে চাপ দিচ্ছে। ঢাকার পেশাদার কূটনীতিকদের মতে, চ্যালেঞ্জের মুখে দায়িত্ব নেয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে একটু সময়ও দেয়নি পশ্চিমা ও ইউরোপের দেশগুলো। নির্বাচনের পরপরই ইইউ পার্লমেন্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেখানে দু’টি বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়। এক. প্রকৃত অর্থে একটি রাজনৈতিক সংলাপ। দুই ওই সংলাপের মধ্য দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান। প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার দু’মাস পর দেশের রাজনীতি ও রানা প্লাজা ধসের বছরপূর্তিতে দেশের শ্রমমান দেখতে ঢাকায় আসে ইইউ পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দল। ৪৮ ঘণ্টা তারা এখানে কাটিয়ে গেছেন। এই সময়ে তারা বিভিন্ন পর্যায়ে ৯টি বৈঠক করেছে। সব বৈঠকেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটসহ বিরোধী দলগুলো দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কারণ এবং শ্রমমান উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন তারা। অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে এ দু’টি বিষয় জানার চেষ্টা করেছেন প্রায় সব বৈঠকেই। প্রসঙ্গগুলো গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে এনেছেন ইইউ’র সংসদ সদস্যরা। সরকারের তরফে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। বিরোধী নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে নির্বাচনের আগে তিনি বিএনপিকে ডেকেছিলেন, দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সরাসরি টেলিফোন করে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জানিয়ে তার এবং সরকারের নেয়া উদ্যোগগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে বিরোধীরা তার ডাকে সাড়া দেয়নি বলে অভিযোগও তুলেছেন। সামনে ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচন। সেখানে যদি কেউ অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়- তাহলে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা কি করবেন? দলনেতা জাঁ লামবার্টের প্রতি সেই প্রশ্নও রেখেছেন শেখ হাসিনা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব বৈঠকে ঘুরে ফিরে অভিন্ন জবাব পেয়েছে ইইউ। তবে ভিন্নতা ছিল বিরোধী ও নাগরিক সমাজের জবাবে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ নিলে কি পরিস্থিতি হতো- উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে তার আলামত দেশ তথা বিশ্ববাসী দেখেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে রক্তাক্ত ওই ভোট দেখিয়ে বিএনপির সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণেরও চেষ্টা করা হয়েছে। জাঁ ল্যামবার্ট বা তার প্রতিনিধিরা বিদায়ের আগে ঢাকায় কোন প্রেস কনফারেন্স করার সময় পাননি। তবে তারা যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি- সেটি সফর শেষ করার মুহূর্তে দেয়া বিবৃতিতেই স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন পেশাদার কূটনীতিকরা। তাদের মতে, ইইউ তার আগের অবস্থানে থেকেই অনেক বিষয় জানতে চেষ্টা করেছে। সরকারের তরফে সাংবিধানিক এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থান তুলে ধরে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। আলোচনায় পাল্টা প্রশ্নও করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা তাদের অবস্থানেই অনড় থেকেছেন। এক কূটনীতিকের প্রশ্ন ছিল কি ধারণা নিয়ে ইইউ দল ফিরে গেছে বলে মনে করেন তিনি? জবাবে তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারির আগে সমঝোতা না হওয়ার বিষয়ে তারা হয়তো সরকারের দেয়া বক্তব্য মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এখন কেন সংলাপ বা সমঝোতা হচ্ছে না- সেটি বোধ হয় তাদের বোঝানো সম্ভব হয়নি। ওই পেশাদার কূটনীতিকের মতে, ইইউ পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দলের সফর শেষ হতে না হতেই ঢাকা আসছেন বৃটিশ উন্নয়ন মন্ত্রী এলান ডানকান। আগামী ৩১শে মার্চ থেকে তিন দিন ঢাকায় অবস্থান করবেন তিনি। এ সময় দুই নেত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। তার সফরে সম্প্রতিক রাজনীতি ও শ্রম পরিস্থিতি গুরুত্ব পাবে। কেবল বৃটিশমন্ত্রীই নন, সামনে পশ্চিমা ও ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যত সফর হবে সবখানেই রাজনীতি ও শ্রমমানের প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হবে। দিনে দিনে কূটনৈতিক চাপ বাড়ার আশঙ্কা করে ওই পেশাদার বলেন, সঙ্কটের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যেই কাটাতে হবে।

শেয়ার করুন