কারাগার সরলো না তিন দশকেও

0
128
Print Friendly, PDF & Email

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয় ১৯৮০ সালে। এরপর প্রায় ৩৪ বছর পার হয়ে গেলেও এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। রাজধানী থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে নিতে প্রায় ১০ বছর আগে কেরানীগঞ্জে নতুন কারাগার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু আজো শেষ হয়নি সেই কাজ। কাগজে-কলমে ৪৭ ভাগ কাজ শেষ হওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ইতিমধ্যে বাড়ানো হয়েছে এই প্রকল্পের মেয়াদও। আর কবেনাগাদ এই কাজ শেষ হবে তা-ও কেউ বলতে পারছেন না। তবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি অংশের কাজ শেষ করে কারাগার স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু করা হবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ। তাও এখনই যদি ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়, তাহলেই সেটা সম্ভব।

কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। তবে এ পর্যন্ত যত টাকা পাওয়া গেছে তার কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি আশা করেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি অংশের কাজ শেষ করে স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে। কারা মহাপরিদর্শক বলেন, কেরানীগঞ্জে জমি অধিগ্রহণেই অনেক সময় চলে গেছে। কারণ এগুলো নিয়ে অনেকেই আদালতে মামলা করেছিলেন। তা শেষ করে কাজ শুরু করতে অনেক সময় লেগেছে। আর মাটি ভরাটের সময় অনেক জায়গায় ১৮ ফুট পর্যন্ত মাটি ভরাট করতে হয়েছে। এতেও অনেক সময় চলে গেছে।

কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৮০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কাউন্সিল সভায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। কারণ হিসেবে সেখানে বলা হয়েছে, জনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে কারাগার থাকায় এর নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। কারণ আশ-পাশের উঁচু ভবন থেকে খুব সহজেই ভেতরে কিছু ফেলা সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে রাজধানীর আশ-পাশে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি ও খোলা জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে। এরপর ১৪ বছর ধরে এ নিয়ে একাধিক বৈঠক ও আলোচনা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রীয় কারাগার সরাতে দু’টি কারাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে একটি গাজীপুরের কাশিমপুর ও অন্যটি রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায়। তবে মূল কেন্দ্রীয় কারাগার যাবে কেরানীগঞ্জে। কিন্তু প্রথমেই কাশিমপুরের কারাগারটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।

কারা সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালেই প্রকল্পের সারপত্র তৈরি হয়। পরের বছরই কাশিমপুরের কারাগারটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এটির কাজ শেষ হওয়ার পর ২০০৩ সালে কারা সংস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে কেরানীগঞ্জের কারাগারটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। পরের বছর প্রকল্প সারপত্র তৈরির পর ২০০৫ সালের জুলাইয়ে প্রকল্প জমা দেয়া হয়। ওই সময়ই প্রকল্পটি অনুমোদন করে সরকার। এরপর ২০০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একনেকেও এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। তখন থেকেই শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। ২০০৭ সালে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে ভবন নির্মাণের কাজ। এখনো চলছে সেই কাজ।

নথিপত্রে দেখা যায়, কেরানীগঞ্জের এই প্রকল্পে অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১৯৪.৪১ একর জমি। ২০০৫ সালের জুলাইয়ে প্রকল্প শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের জুন মাসে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য বাজেট ধরা হয়েছে ৩৩৭ কোটি ৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। কারা কর্তৃপক্ষের হিসেবে এ পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া গেছে ১৬০ কোটি টাকা। যা মূল টাকার ৪৭ ভাগ। এই পরিমাণ কাজও হয়েছে বলে দাবি কারা কর্তৃপক্ষের। এই প্রকল্পে বিচারাধীন ৪ হাজার হাজতিদের জন্য একটি, ৪ হাজার সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের জন্য একটি ও ৩০০ নারী বন্দীর জন্য একটি কারাগার এবং ২০০ শয্যার একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল হওয়ার কথা। এর মধ্যে প্রথম ধাপে বিচারাধীন হাজতি ও নারীদের কারাগারটি নির্মাণ শেষ হলেই স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র হল— এ পর্যন্ত হাজতিদের জন্য কারাগার নির্মাণ কাজ অনেকদূর এগুলেও নারী বন্দিদের জন্য কারাগার নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি। আর ‘পেরিমিটার ওয়াল’ (উঁচু ওয়াল) তৈরি হলেও বাউন্ডারির (সীমানা প্রাচীর) কাজ শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এর জন্য নতুন করে টেন্ডার দেয়া হবে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। আর আবাসিক ভবনগুলোর কাজ এক-তৃতীয়াংশও শেষ হয়নি।

জানা গেছে, কারা কর্মকর্তাদের জন্য ২০৪ ইউনিটের কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ৭২ ইউনিটের কাজ শেষ হয়েছে। আর ৩০০ কারারক্ষী থাকার জন্য ব্যারাক নির্মাণের কাজও অবশ্য শেষ হয়েছে। কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন বলেন, কারাগারের নির্মাণ কাজ শেষ হলেই আমরা স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব না। এর জন্য আগে আবাসনের কাজ শেষ করতে হবে। কারণ ওই এলাকার আশ-পাশে থাকার মতো কোন স্থাপনা নেই। আর ঢাকা থেকে কর্মকর্তা ও কারারক্ষীরা প্রতিদিন ওখানে গিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। তাই আবাসনটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। এরপরই স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।

প্রসঙ্গত, রাজধানীর পুরনো ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে ১৭৬৫ সালে ১০টি ওয়ার্ড নির্মাণ করে সাধারণ বন্দিদের রাখা হতো। এরপর ১৭৮৮ সালে এই ওয়ার্ডগুলোতে বড় অপরাধীদের রাখা শুরু হয়। সেই থেকেই শুরু হয় ঢাকা কারাগারের যাত্রা। ১৯০২ সালে ৩৯ একর জমি নিয়ে বৃহত্ পরিসরে যাত্রা শুরু করে কারাগারটি। তখন থেকেই মূলত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে পরিচিতি পায় এটি। ১১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হচ্ছে বন্দিদের। তবে পাকিস্তান আমলে এই কারাগারের আশ-পাশের অনেক জমি বেদখল হয়ে যায়। এখন সব মিলিয়ে ১৬/১৭ একর জমি রয়েছে। ১৯৮০ সালে আশ-পাশে বড় ভবন হওয়ার কারণে কারাগারটি সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার

শেয়ার করুন