বাংলাদেশের এই মুহুর্তে বড় সমস্যা রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যেকার বেড়ে উঠা ব্যবধান। মূলত রাষ্ট্রের সরকারী অংশের এক ধরণের ধারা আর সমাজের আরেক ধরনের রাজনৈতিক ধারা তৈরি হয়েছে। ফলে গণতন্ত্র চর্চার ধারাও দুইভাবে বিভক্ত। ৪৩ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেকটা দুর্বল। ১৯৭৩ – ’৭৪ এর এই সময়টুকুই পূর্ণ সাংবিধানিক ক্ষমতায়ন ছিল দেশে যদিও প্রবলভাবে ত্রুটিপূর্ণ, বিশেষ করে সংবিধান বহির্ভুত ক্ষমতা প্রয়োগ যা শুরু হয় রক্ষী বাহিনী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তারপর বাকশাল, জরুরি অবস্থা, মার্শাল ল’ এলো। এই তিনের চক্রেই আমাদের রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বন্দি। প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র নির্মাণে সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোও এই চক্রে আবদ্ধ। তাই সেগুলোও ব্যর্থ ও জনকল্যাণ বিবর্জিত। ফলে বিএনপি’র সময়ে দেশ যেমন চলে, আওয়ামী লীগের সময়েও একইভাবে চলে। এই পরিস্থিতিতে সবাই রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র চর্চার কথা বলছে। কিন্তু জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। ’৭৫ কিংবা ’৯০ এর দিকে এই সংকট হলে এটিকে ভদ্রস্থ কোনো রূপ দেয়া যেতো। এখন বোধহয় আর সম্ভব নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার একদিকে যেমন এরশাদকে হটানোর অস্ত্র, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির দুর্বলতার প্রমাণ। পৃথিবীর অন্যকোনো দেশে নির্বাচনের অর্ন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য সরকার আনতে হয় না। এটা ব্যর্থতার সূচক। তবে এবার আওয়ামী লীগ যা করেছে তা হল, তারা বুঝে শুনে ক্ষমতায় যাবার ব্যবস্থা করেছে ১৫তম সংশোধনী পাশ করে। আবার বিএনপি ’৯৬তে যা করেছে তাও ক্ষমতা দখলের জন্যই। ২০০৬ সালেও একই কাজ করেছিল দলটি। এই চর্চা দিনদিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। তাই সহজেই বলতে পারি আমাদের আর রাজনীতির ইতিহাস নেই। গণতন্ত্রের ইতিহাস নেই। আছে ক্ষমতা দখলের ইতিহাস।
তাই গণতান্ত্রিক চর্চা বলতে আমরা রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার চর্চা বুঝি। এটা মোটেই গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্যকে প্রতিফলিত করে না। গণতান্ত্রিক চর্চা হলে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা থাকবে। গণতান্ত্রিক চর্চা হলে ভোটের তারিখ একবারেই নির্ধারিত হয়ে থাকবে। প্রতিবারে ভোটের সময়ে এতো ঝামেলা মোকাবেলা করতে হবেনা। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন কয়েক ভাগে ভাগ করেও বিশেষ সুবিধা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইচ্ছামতো নির্বাচনে অংশ নেবার কথা বলছে। নিজেদের দাবী পূরণ না হলে নির্বাচন বর্জন করছে। আবার সবাই বর্জন করলে সেই নির্বাচন করার অর্থ কি? দলীয় এই চালাচালিতে জনগণের আস্থা নেই। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এই গণতন্ত্রচর্চা সমাজের সাধারণ মানুষের মাঝে প্রবেশ করছে না।