বাংলাদেশ কার্যত দীর্ঘদিন ধরে প্রবল শক্তিধর ও কর্তৃত্ববাদী নির্বাহী ক্ষমতার আশ্রয়স্থল হিসেবে বিরাজ করছে। সরকারের প্রধান নির্বাহী সবসময়ই এই ব্যবস্থার ‘মধ্যমণি’ হয়ে আছেন। স্বীকৃত গণতন্ত্র বা প্রকাশ্য ও গোপন স্বৈরতন্ত্র- সবই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ব্যাপকভাবে কেন্দ্রীভূতকরণ ও পঞ্জিভূত করা প্রত্যক্ষ করেছে। এ কারণে অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ কোনো না কোনো ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের শিকার হয়েছে। পালাবদল এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী ভূমিকা ও ক্ষমতা দেশটির পরিবর্তনশীল ‘ক্ষমতার সম্পর্কের আত্মচরিত’ ফুটিয়ে তুলেছে।
ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশ মহান ও বীরোচিত সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১-পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশধর্মী শাসন থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের জনগণ প্রধানত আধুনিক ভাষা, ভৌগোলিক জাতীয়বাদ ও গণতন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থার জন্য মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। তারপর স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকার সময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালের সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি দিয়ে। এই সংবিধানের মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হারম্যান ফাইনার যথাযথ লিখেছেন যে, যে কোন সমাজে ‘সংবিধান হলো সেখানকার শক্তি বর্গের ক্ষমতার পারস্পরিক সম্পর্কের আত্মচরিত।’ বাংলাদেশেও বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যময় সামাজিক শক্তির ‘ক্ষমতার সম্পর্কের’ পালাবদলের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। রাষ্ট্রের একের পর এক সঙ্কটের সাথে একে তার বৈশিষ্ট্যের সাথে খাপ খাওয়াতে হয়েছে। সরকারও কয়েকবার তার ধরন পরিবর্তন করেছে। অস্বাভাবিক কিছু পরিস্থিতির কারণে রাষ্ট্র একটি এক দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংসদে ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এক দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রের প্রধান হন সর্বময় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি, তিনি কেবল রাষ্ট্রের প্রধান না হয়ে সরকারের নির্বাহী প্রধানও হন।
সরকারের ধরন রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে পরিণত হয়। অবশ্য তা ছিল বেসামরিক শাসন। ওই বছরের আগস্টে বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সাথে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। ১৯৭৫ সালের আগস্টে দুঃখজনক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ আমলের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়, সামরিক শাসন জারি হয়। এরপর কয়েকটি অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের পর স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। ১৯৭৯ সালে জিয়া সামরিক শাসন প্রত্যাহার করেন, শক্তিশালী রাষ্ট্্রপতি-সংবলিত বহু দলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানে এক দল সামরিক কর্মকর্তার হাতে তিনি নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সালের মার্চে জেনারেল এরশাদ আবার সামরিক শাসন জারি করেন। এরশাদ ১৯৮৬ সালে ফের সরকারকে বেসামরিক করলেও ১৯৭৫ সাল থেকে চালু থাকা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি বহাল থাকে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে শক্তিশালী গণবিক্ষোভে প্রেসিডেন্ট এরশাদের উৎখাত ঘটে।
এরশাদ জান্তার পতনের পর সব রাজনৈতিক শক্তির সম্মতিতে অন্তর্বর্তীকালীন, এক নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে বিএনপির জয়ের পর দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় মন্ত্রিসভা পদ্ধতির ওয়েস্ট মিনিষ্টার ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী হন নির্বাহী প্রধান, রাষ্ট্রপতি হন সাংবিধানিক প্রধান।’
দ্বাদশ সংশোধনী অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা যায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে এবং তার মন্ত্রিসভা সামষ্টিকভাবে জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। অবশ্য সরকারের সব নির্বাহী পদক্ষেপ রাষ্ট্রপতির নামেই গ্রহণ করা হয়, যদিও কার্যত রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা থাকেনা। তাত্ত্বিকভাবে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে। কিন্তু এ ধরনের ক্ষমতা নিছকই আলংকারিক। ‘ব্রিটিশ রাজা বা রানীর মতো রাষ্ট্রপতি সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করেন, ক্ষমতা নয়।’
সন্দেহ নেই যে, দ্বাদশ সংশোধনীতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ইচ্ছার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছিল। এসবের প্রতিনিধিত্ব করছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দল। ক্ষমতার পারস্পরিক সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটে এবং সংবিধানে তার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে।
তবে দ্বাদশ সংশোধনীর উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় সত্যিকারভাবে বাস্তবায়িত হয়েছেল কি না সে প্রশ্ন রয়েই যায়। দৃশ্যত এর পর আরো তিনটি সংশোধনীর পর সংবিধানটি প্রকৃত সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সৃষ্টি করে। তবে জনগণের বিশাল অংশ ভিন্ন ধারণা পোষণ করে। তারা মনে করে যে বাংলাদেশে পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মন্ত্রিসভা সংসদীয় পদ্ধতি নয় প্রধানমন্ত্রী শাসিত এক ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। সংবিধান হয়তো প্রধান নির্বাহী তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরনের ক্ষেত্রে তার নির্ধারিত ভূমিকা রেখেছে। বিদ্যমান বাস্তবতা এবং ‘বিরাজমান অবস্থা’ দেখে মনে হচ্ছে ওয়েস্ট মিনিষ্টার ধরনের সংসদীয় সরকারের অধীনে যেটুকু নির্বাহী ক্ষমতা থাকে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা রয়েছে।
কৌতূহল উদ্দীপক ঐতিহাসিক বিবর্তন পরিক্রমায় হলেও মন্ত্রিসভা-সংসদীয় ধরনের সরকারের এই ব্যবস্থা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। ব্রিটেনে যে মূল আকারে এর উদ্ভব ঘটেছে, তাতে সংসদীয় সার্বভৌমত্ব, সংসদের কাছে মন্ত্রিসভার সামষ্টিকভাবে দায়ী থাকা, প্রধানমন্ত্রীকে সমানদের মধ্যে প্রথম (প্রাইমাস ইন্টার পেরেস) হিসেবে বিবেচনা করার ধারণা এবং সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ‘কর্তব্যনিষ্ঠ বিরোধী দলের’ রেওয়াজ দেখা যায়। এই ব্যবস্থায় জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রিসভার মাধ্যমে সরকার গঠন করে। তবে সংখ্যালঘিষ্ঠ দল বা দলগুলোকে নিয়ে গঠিত বিরোধী দলও কার্যত সরকারের অংশে পরিণত হয়, যা ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন দলে পরিণত হতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল সম্ভাব্য বিকল্প সরকার এবং একই সময়ে সরকারের অংশ হিসেবে থাকে, এমনকি সাংবিধানিক বিরোধী দলের দায়দায়িত্ব পালন করে।
নেতৃত্বের এই ভাগাভাগি অন্যান্য ধরনের গণতন্ত্র যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির গণতন্ত্রেও বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট হলো সুসংগঠিত বিরোধী দল।
ব্রিটেনে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবস্থাটি বর্তমান রূপ পেয়েছে, বাংলাদেশ সেই সুবিধাটি পায়নি। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এমন সব বিষয় ও ঘটনায় পরিপূর্ণ যা সংসদীয় ব্যবস্থাটিকে বিকৃতির দিকে পরিচালিত করেছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারের আকারে বেসামরিক ও সামরিক শাসন চালু ছিল। ওই ব্যবস্থায় কার্যত রাষ্ট্রপতি ছিলেন সব নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী। বলা যায়, দেশ এমন ব্যক্তির হাতে শাসিত হয়েছে, যিনি সংবিধানে অনুমোদিত ক্ষমতার চেয়েও বেশি ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগ করেছেন। সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ওই ঐতিহ্য প্রায় পুরোপুরিই অব্যাহত থাকে। কার্যবিধি অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারে মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী প্রধান নন। তারা কেবল স্থায়ী সচিবদের তদারককারী। এই সচিবরা নির্বাহী প্রধানের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়গুলোর প্রধান দায়দায়িত্ব বহনকারী কর্মকর্তা। উপর্যুপরি প্রথম দুটি সংসদীয় সরকারের সাত বছরের আমলে এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের মন্ত্রী ও সচিবদের সাথে রাষ্ট্রপতির মতো সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। ১৯৯৭ সালে কার্যবিধিতে পরিবর্তন আসে, মন্ত্রীরা তাদের মন্ত্রণালয়ে নির্বাহী প্রধান হন। বাস্তবে এটা ছিল প্রকৃতিগতভাবে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন। কিন্তু, এসব সত্বেও সর্বময় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতির ঐতিহ্য ১৯৯০-পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সংসদীয় সরকারগুলোতেও প্রবলভাবে অব্যাহত থাকে। ব্যক্তি নির্বিশেষে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে আরো শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর অবস্থায় দেখতে পান। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই দশকের সংসদীয় শাসনকালে প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটার অনেক কারণ রয়েছে।
প্রথমত, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও সংস্কৃতির বাস্তবতা ওয়েষ্ট মিনিষ্টার পদ্ধতির সংসদীয় মন্ত্রিসভা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করে। এসব অস্বস্তিকর বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে সংসদের ভূমিকার, দূর্বলতা রাজনৈতিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক ও নেত্রী কেন্দ্রিকতা, বিরোধী দলকে খর্ব করে রাখা, আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ, সমাজে দুর্নীতির পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষক এবং অনুগতের সম্পর্কের সূচনা ও সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের বিশেষ করে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা হ্রাস এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা ও শক্তি ভয়াবহ মাত্রায় কমে যাওয়া।
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল কার্যত রবার্ট মিশেলের ‘অভিজাততন্ত্রের লৌহ সূত্রের শিকারে’ পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা, আইভরিকোস্ট, জিম্বাবুয়ে এবং অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও রাজনৈতিক উন্নয়নের অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত এসব দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা নগ্ন ও স্থূল সংগ্রামে পর্যবসিত হয়। এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলগুলো কার্যত রবার্ট মিশেলের ‘অভিজাততন্ত্রের লৌহ সূত্রের’ শিকার হয়। ১৯১১ সালে রচিত গ্রন্থে এই জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ তাঁর রাজনৈতিক তত্ত্বে স্পষ্টভাবে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে যে যেকোনো সংগঠনের মধ্যে ‘কৌশলগত ও কারিগরি প্রয়োজনের’ কারণে ‘লৌহ কানুন’ হিসেবে ‘এলিট বা অভিজাতদের শাসন’ অপরিহার্য। মিশেল তার এই নিয়মটি বিশেষভাবে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংগঠনই নির্বাচকদের ওপরে নির্বাচিতদের, নির্দেশকদের ওপরে নির্দেশীদের, নির্বাচক ওপরে প্রতিনিধিদের আধিপত্যের সূচনা করে। যারা সংগঠনের কথা বলে, তারা বলে অভিজাততন্ত্রের কথা।’ তিনি আরো বলেন, ‘অভিজাততন্ত্র প্রতিরোধের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, ঐতিহাসিক বিবর্তন সেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতি উপহাস করেছে।’ মিশেল উল্লেখ করেছেন, অভিজাতচক্র শাসন অবসানের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জন ছিল অসম্ভব। কারণ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র আসলে বিশেষ অভিজাতদের শাসন বৈধ করার সদর দরজা। আর এলিটদের শাসন, যাকে তিনি অভিজাততন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন, তা অনিবার্য।
সংগঠনকে কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীভূতকরণ করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ক্ষমতা পঞ্জিভূত হয়। এই মুষ্টিমেয় লোকের বা অভিজাতরা সম্ভব সকল উপায়ে তাদের ক্ষমতা সুরক্ষিত করে এবং আরো বাড়িয়ে নেয়।
স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনুগত কর্মীদের সহায়তায় দলের নেতা হবেন সর্বোচ্চ ব্যক্তি এবং বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। রবার্ট মিশেল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমলাতন্ত্র ইচ্ছাকৃতভাবেই নেতার হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পথ সৃষ্টি করে। নেতারা শাস্তি ও পুরস্কার দেওয়ার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ করেন। যারা তাদের অভিমত সমর্থন করে, তারা তাদের পদোন্নতি দেন, পরিণতিতে অনিবার্যভাবেই নিজের সৃষ্ট স্থায়ী অভিজাততন্ত্রের পথ রচনা করেন। গড় রাজনৈতিক দক্ষতার বেশি আছে বলেই লোকজন নেতৃত্বের অবস্থানে পৌঁছেন। তাদের ক্যারিয়ার যত এগুতে থাকে, তাদের ক্ষমতা ও মর্যাদাও বাড়তে থাকে। নেতারা নিম্ন পর্যায়ে প্রবাহিত তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, সাধারণ কর্মীরা যাতে তা না জানতে পারে, সেজন্য বিধিনিষেধ আরোপ করে। সাধারণ কর্মীরা যাতে নেতৃবৃন্দের অবস্থানকেই পুরোপুরি সঠিক মনে করে, সেজন্য নেতারা বিপুল সম্পদ সে খাতে ব্যয় করেন। বেশিরভাগ সমাজেই এটা প্রযোজ্য : লোকজনকে কর্তৃত্বমূলক অবস্থানে অবস্থানকারীর অনুগত থাকতে শিক্ষা দেওয়া হয়। ফলে সাধারণ কর্মীরা সামান্যই আগ্রহী থাকে। তারা বরং নেতাদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ এবং পালনীয় নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।’
প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থায় সরকারের আমলাতন্ত্রের মতো দলের আমলাতন্ত্রও অনেকাংশেই ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। শুরু থেকেই উভয় দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তাদের অনুকূলে বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকীকরণ করেছে। পার্থক্যটা মাত্রাগত, প্রকৃতিগত নয়। দলগুলো এবং আমলাতন্ত্র বছরের পর বছর প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের নির্বাহী প্রধানের হাত আরো শক্তিশালী করার প্রবণতা প্রদর্শন করেছে।
সংসদের নিজ দলীয় সদস্যরা অনুগত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ানোর ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ ফ্লোর ক্রস করা সদস্যকে সদস্যপদ হারানোর ভয় দেখিয়ে ওই কাজ থেকে নিবৃত্ত করার ব্যবস্থা করেছে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সংসদীয় দল প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারকে আরো শক্তিশালী করেছে।
গণতন্ত্র ক্ষুণ্নকারী আরেকটি বিষয় হচ্ছে বিরোধী দলকে কাক্সিক্ষত মর্যাদা ও ভূমিকা পালন করতে না দেওয়া। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যারাই ক্ষমতায় আসেন, তারা পার্লামেন্টের সাংবিধানিক বিরোধী দলকে কোনঠাসা করে রেখেছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য আছে সামান্যই। পার্লামেন্টের ভেতর ও বাইরে বিরোধী দলের ভূমিকা ও ক্ষমতা হ্রাসের ফলে প্রকৃত গণতন্ত্রের অবনতি ঘটেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা প্রবল প্রতাপে বাংলাদেশের অনিশ্চিত গণতন্ত্রের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
এর সাথে যোগ হয়েছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের ঘোষিত পৃথকীকরণ সত্ত্বেও নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার অভাব, সমাজের বিভিন্ন স্তরে শাসক এবং তাদের আনুকল্যপ্রাপ্তদের মধ্যকার পৃষ্ঠপোষক ও পোষিতের সম্পর্কের বিকাশ, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের প্রকৃত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হ্রাস এবং ঘোষিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্য যে কারো চেয়ে প্রধান নির্বাহীকে অধিকতর শক্তিশালী করার নির্দেশনা।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী নিয়ন্ত্রিত শাসন আরো জোরদার হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে। ১৯৯১ সালের পর এবারই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে ১৯৯৬ সালে প্রবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে দেয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচন বয়কট করে। তারা সহিংস বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এর ফলে ভোটার উপস্থিতি হয় খুবই কম এবং বিপুল সংখ্যক এমপি নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। জাতীয় সংসদে ৩০০ এমপির মধ্যে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অর্ধেকের বেশি ভোটার তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাননি। অন্য ১৪৬ জনও নির্বাচিত হয়েছেন প্রধান বিরোধী দলগুলোর বয়কটের মধ্যে এবং এর পরিণতিতে তুলনামূলক স্বল্প ভোটার উপস্থিতির মধ্যে। ফলে এই নির্বাচন দেশে এবং বিদেশের পর্যবেক্ষকদের কাছে সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে যে বিরোধী দলকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করার রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি গ্রহণের চেয়ে ছলচাতুরি ও জোটবদ্ধতাই বেশি ভূমিকা পালন করেছে। গণতন্ত্র কেবল দুর্ভোগই পোহাবে না, বরং সেইসঙ্গে নিজেকে দুর্বল অবস্থানেও দেখতে পাবে। এটা দলের নেতার, যিনি সরকারেরও প্রধান নির্বাহী, হাতে আরো বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ও পুঞ্জিভূত করবে। প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থা একনায়কত্বে পরিণত হলে তা গণতন্ত্রকে আরো দুর্বল করে তুলবে। এটা রাজনৈতিকব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে আরেক দফা অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।।
লেখক: চিন্তাবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী সাহিত্যিক ও সেন্টার ফর ডেভেল্পমেন্ট রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিডিআরবি)-র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং আর্থ-সামাজিক ত্রৈমাসিক ‘এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের’ সম্পাদক।