ভারতে বাতিল অথচ রামপালে সরকার মরিয়া কেন?

0
142
Print Friendly, PDF & Email

গত ১৩ মার্চ ২০১৪ তারিখে ভারতের ন্যাশনাল গ্রীণ ট্রাইবুনাল কর্ণাটক রাজ্যে ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল করপোরেশন (এনটিপিসি) এর প্রস্তাবিত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ ছাড়পত্র স্থগিত করে দিয়েছে। কর্ণাটক রাজ্যের বিজাপুর জেলার কুজ্জি গ্রামে এনটিপিসি’র ২৪০০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ ছাড়পত্র স্থগিতের আদেশে বলা হয়েছে:

১) এনটিপিসি পরিবেশছাড় পত্র পাওয়ার জন্য প্রকল্প এলাকার জমি সম্পর্কে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে, দুই ফসলী কৃষি জমিকে অনুর্বর ও পাথুরে জমি বলে চালিয়ে দিয়েছে।

২) এনটিপিসি কর্তৃক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রণয়ণের আগেই পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছে।

৩) পরিবেশ সমীক্ষার শর্ত অনুসারে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বায়ুর সম্ভাব্য গতিপথে মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করে সালফার ও নাইট্রোজেন অক্সাইড দূষণের বিদ্যমান মাত্রা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার পর সম্ভাব্য মাত্রা এবং আশপাশের পরিবেশের উপর তার প্রভাব হিসেব করা উচিত ছিল। কিন্তু এনটিপিসি পরিবেশ সমীক্ষার এই শর্ত সঠিক ভাবে পালন করেনি।

৪) গণশুনানির সময় স্থানীয় জনগণ কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগগুলোর উপযুক্ত জবাব না দিয়েই এই ছাড়পত্র দেয়া হয়। প্রকল্প এলাকার অধিবাসীদের যে অভিযোগগুলো আমলে নেয়া হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, তার কয়েকটি হলো:

ক) প্রকল্পের চারপাশের কুজ্জি, তেলাগি, মাসুতি এবং গোলাসাংগি গ্রামে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শব্দ দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

খ) কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে নির্গত বাতাসের সালফার এবং উচ্চমাত্রার কারণে আশপাশের জমির উর্বরতা নষ্ট হবে।

গ) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ছাইয়ের কারণে আশপাশের গাছপালা ও শস্যের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

ঘ) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ছাই ধোয়া পানি বা স্লারি চারপাশের কৃষিজমি,নদী-নালা-খালবিল দূষণ করবে।

ঙ) কুজ্জি গ্রাম গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে পান উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। নির্গত ছাইয়ের কারণে এই পানের আবাদ নষ্ট হবে।

চ) আলমাত্তি ড্যাম থেকে পানি প্রত্যাহারের ফলে পানি সংকট তৈরী হবে। বর্ষাকালে ছাই ধোয়া পানি বাধের পানি দূষিত করবে এবং নদীতে প্রতি বছর ৪ থেকে ৬ ফুট পুরু ছাইয়ের স্তুপ জমবে। এই ছাই কিভাবে পরিস্কার করা হবে তা স্পষ্ট নয়।

এই অভিযোগগুলোর পক্ষে গ্রামবাসী কোন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ দিতে পারেনি বলে এনটিপিসি যুক্তি হাজির করলে, এ বিষয়ে ট্রাইবুনালের রায়ে বলা হয়- অভিযোগ প্রমাণের দায় গ্রামবাসীর নয় বরং অভিযোগগুলো অমূলক কিনা তার প্রমাণের দায় সর্ম্পূর্ণই এনটিপিসির।

সংক্ষেপে, পরিবেশ ছাড়পত্রের সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা, উদ্দেশ্যমূলক ভাবে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান ও তথ্য গোপন করা, প্রকল্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর নিস্পত্তি না করেই ছাড়পত্র প্রদানের কারণেই ভারতের ন্যাশানাল গ্রীণ ট্রাইবুনাল এনটিপিসির কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাড়পত্র স্থগিত করে পুরো বিষয়টি ছয় মাসের মধ্যে পুনর্বিবেচনা করার আদেশ দিয়েছে।

এনটিপিসি’র বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ নতুন নয়- বিভিন্ন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ জনগণের পুর্নবাসন, ক্ষতিপূরণ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অভিযোগ তো আছেই, খোদ ভারতীয় কর্তৃপক্ষই বিভিন্ন সময় এসব বিষয়ে এনটিপিসি’র এসব কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। যেমন:২০১০ সালের ৭-৯ জুলাই অনুষ্ঠিত ভারতীয় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কয়লা খনির পরিবেশ সমীক্ষা বিষয়ক এক্সপার্ট অ্যাপরাইজাল কমিটি এনটিপিসি কর্তৃক ছাই ব্যবহার সম্পর্কে মন্তব্য করে:

‘The Committee further observed that the present volume of fly ash generated and the quantity utilized from M/S NTPC Ltd. power plants all over the country is far from satisfactory. The Committee therefore desired that a detailed road map of fly ash utilization for all the power plants in operation shall be prepared and placed before the Committee in its meeting scheduled during the September, 2010. The Committee also decided that the audited report of fly ash utilization (as may be indicated in the last Annual Report of M/S NTPC Ltd.) may also be presented before the Committee.’

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি ভারতে এনটিপিসির বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকা পরিদর্শন করেও তার সত্যতা পেয়েছে।

যে সকল গুরুতর অভিযোগের কারণে ভারতের গ্রীণ ট্রাইবুনাল এনটিপিসির কর্ণাটকের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ ছাড়পত্র স্থগিত করেছে, বাংলাদেশের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এর চেয়ে গুরুতর প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও এনটিপিসি ও পিডিবি’র যৌথ বিনিয়োগের এই প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ‘অগ্রাধিকার’ প্রকল্প হিসেবে নির্ধারণ করেছে। কর্ণাটক রাজ্যের ঐ প্রকল্পের মতো বাংলাদেশের সুন্দরবনের পাশে রামপাল প্রকল্পের পরিবেশ সমীক্ষার বিরুদ্ধে অনেকগুলো অনিয়ম, তথ্য গোপন, ভুল তথ্য প্রদান, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ আছে যেমন:

ক) পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন করার আগেই জমি অধিগ্রহণ ও প্রকল্পের কাজ শুরু। লোক দেখানো গণশুনানি আয়োজন এবং গণশুনানিতে উত্থাপিত অভিযোগ আমলে না নেয়া;

খ) ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি কর্তৃক ভারতের পরিবেশ অধিদপ্তরের গাইড লাইন অনুসারে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিমি এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করার নিয়ম ভঙ্গ করা;

গ) সুন্দরবনকে পরিবেশগত স্পর্শকাতার এলাকার বদলে আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা বলে দেখিয়ে সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের সম্ভাব্য ক্ষতিকে সহনীয় মাত্রায় দেখানোর চেষ্টা;

ঘ) সমীক্ষার শর্তানুসারে সবক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ও প্রাথমিক ডাটা ব্যাবহারের বদলে সুবিধা অনুযায়ী পুরাতন ও সেকেন্ডারি ডাটা ব্যাবহার করা।

ঙ) সারাবছর বাতাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হবেনা বলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা;

চ) আশপাশের কৃষিজমি, নদী-নালা ও সুন্দরবনের উপর কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ছাই, ছাই ধোয়া পানি, ছাইয়ের মধ্যে থাকা বিষাক্ত ভারী ধাতুর ক্ষতিকর প্রভাব অস্বীকার;

ছ) সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে কয়লা পরিবহনের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেখানো;

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম সুন্দরবন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে এমনিতেই বিপর্যস্ত। এই বিপর্যস্ত সুন্দরবনকে রক্ষার প্রকল্প নেয়ার বদলে উল্টো এনটিপিসির মতো একটি বিতর্কিত ও পরিবেশ বিষয়ে বিপদজনক ট্র্যাক রেকর্ড সম্পন্ন কোম্পানির সাথে যৌথ বিনিয়োগে সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিমি এর মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নি:সন্দেহে আত্মঘাতী একটি পরিকল্পনা। তাই জনগণের দাবি, সরকারকে অবিলম্বে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং জনগণের উচিত সুন্দরবন ধ্বংসের এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।।

শেয়ার করুন