‘ছাত্রলীগের প্রত্যেককেই চাকরি দিতে হবে। রেজাল্টের প্রয়োজন নেই, তাদের গায়ে থাকা পুলিশি নির্যাতনের ক্ষতই একমাত্র যোগ্যতা। আর কোনো যোগ্যতার প্র্রয়োজন নেই’ বলে দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের(ঢাবি) রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও ঢাবির আওয়ামী সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজের বিতর্কিত বক্তব্যে তোলপাড় চলছে।
গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৯৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাবির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল চত্ত্বরে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনাসভায় ছাত্র-জনতা এবং সাংবাদিকদের সামনেই সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুরের কাছে ‘ছাত্রলীগের সব কর্মীকে চাকরি দিতে হবে’ বলে দাবি জানান অধ্যাপক আবদুল আজিজ। চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে রেজাল্ট নয়, বরং তাদের গায়ে থাকা পুলিশি নির্যাতনের ক্ষতকেই একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
খবরটি ওইদিন দুপুরে বাংলানিউজে প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে সব মিডিয়া এবং টিভি টকশো’তেও ওই বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। এ বক্তব্য নিয়ে চাঞ্চল্য চলছে এখনো।
ওই শিক্ষকের এমন বক্তব্যকে ‘দুর্ভাগ্যজনক এবং বিব্রতকর’ বলে আখ্যায়িত করে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার বিকল্প নেই বলে অভিমত দিয়েছেন ঢাবির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও মিডিয়াব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান সম্প্রতি বাংলানিউজের কাছে এ ব্যাপারে নিজ নিজ অভিমত তুলে ধরেন।
অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজের ওই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন খোদ ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, কে কোন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটা বড় কথা নয়। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র মানদণ্ড হচ্ছে মেধা ও যোগ্যতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে যেমন একমাত্র যোগ্যতা তার মেধা, চাকরির ক্ষেত্রেও সেটাই হওয়া উচিত।
‘ওই শিক্ষকের বক্তব্যের দায় তার নিজের এবং তা কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের ওপর বর্তায় না’ বলেও মন্তব্য করেন উপাচার্য।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, চাকরি দিতে হবে মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে, কোন রাজনৈতিক সংযোগের ভিত্তিতে নয়। কারণ, দেশ পরিচালনায় কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নয়, প্রয়োজন মেধা ও যোগ্যতার। এ কথাটা হয়তো ওই অধ্যাপক নিজেও জানেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজেও ছাত্রলীগকে বলতেন, ‘বাবারা তোমরা একটু পড়াশোনা করো, শুধু জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ করো না’। এ কথাটা ছাত্রলীগকে মেনে চলতে হবে।
একজন শিক্ষকের মুখে এ ধরনের বক্তব্য ছাত্র সংগঠেনগুলোর মাঝে অযৌক্তিক আশার সঞ্চার করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
তবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একমাত্র মেধা যোগ্যতার কথা বললেও স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এমন কাউকে চাকরিতে নিয়োগের পক্ষপাতী আমি নই।
ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, একজন শিক্ষক হিসেবে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া অন্য শিক্ষকদের জন্য বিব্রতকর, দুর্ভাগ্যজনক এবং একই সঙ্গে লজ্জার। কারণ, একজন শিক্ষকও যদি এমন বক্তব্য দেন, তাহলে তার দায়ভার অনেক সময় অন্য শিক্ষকদের ঘাড়েও বর্তায়। নানাজন এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। যদিও ঢাবির ৯৯ শতাংশের বেশি শিক্ষক এ ধরনের বক্তব্যকে সমর্থন করবেন না।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, একজন শিক্ষকের এ ধরনের বক্তব্যই অনেক সময় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে দাগ লাগার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এ ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা হাতেগোনা। কারণ, বেশিরভাগ শিক্ষককেই আমি চিনি।
নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ওই বক্তব্য ওই শিক্ষকের ব্যক্তিগত। কারণ, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা এবং যোগ্যতাই আসল, কে কোন সংগঠন করলো সেটা বড় কথা নয়।
প্রচলিত কোটা ব্যবস্থার সমালোচনা করে বরেণ্য এ অধ্যাপক বলেন, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে কোটা ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিক আছে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এটা অযৌক্তিক। সুতরাং কোটা ব্যবস্থারও সংস্কার করা জরুরি।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং উপমহাদেশে সাংবাদিকতা বিষয়ের প্রথম ডক্টরেট অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান রহমানও মনে করেন, ওই শিক্ষক সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বেই এমন বক্তব্য দিয়েছেন, যা কোনোক্রমেই শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সংগঠন করলেই বা নির্যাতিত হলেই সে চাকরি পাবে এটা সমর্থনযোগ্য কথা না। শিক্ষক হিসেবে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া কোনোক্রমেই সমীচীন হয়নি। কোনো শিক্ষকই এ ধরনের কথা মেনে নেবেন না। এমনকি ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল নেতারাও হয়তো এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন না। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার বিকল্প নেই।
তবে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সেই শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম।
যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ বাংলানিউজকে বলেন, এ ব্যাপারে আমি আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোনকল রিসিভ করেন নি। খুদে বার্তার মাধ্যমে বক্তব্য জানতে চাওয়া হলেও তারা কোনো প্রত্যুত্তর পাঠান নি।
** চাকরি পেতে ছাত্রলীগের রেজাল্টের প্রয়োজন নেই