ব্যালট পেপার ছিনতাই, মৃত্যু, জালভোট, কেন্দ্র দখল, নির্বাচন বর্জন-স্থগিত, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে গতকাল রোববার উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপের ৯১ উপজেলার ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলে। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে গোলযোগ দেখলে সেনাবাহিনীকে সরাসরি হস্তক্ষেপের নির্দেশনা দেয়ার পরও নির্বাচনী সহিংসতায় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া এবং ঝালকাঠির রাজাপুরে ৪ জন নিহত ও কয়েকশ’ লোক আহত হয়েছেন। স্থগিত করে দেয়া হয়েছে ৩২টি ভোটকেন্দ্র। শেষ মুহূর্তের এ ঘোষণায় আশ্বস্ত দেশের জনগণ এবং নির্বাচন বিশ্লেষকরা এ ঘটনায় যেমন অনেকটাই অবাক হয়েছেন তেমনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে ইসিও। নির্দেশনাটি অনেকটা আইওয়াশ ছিল মাত্র এমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ।
ভোটের আগের দিন শনিবার নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, সহিংসতায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করলে গুলি করা হবে। পাশাপাশি চতুর্থ পর্বে ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিইসির ই-মেইল পেয়ে নির্বাচন কমিশনাররা বৈঠক করে সহিংসতা ঠেকাতে সক্রিয় থাকার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকেও চিঠি পাঠায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বরং গত তিন ধাপের নির্বাচন থেকে চতুর্থ দফায় আরো ব্যাপক সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
ভোটগ্রহণ শেষে গতকাল সন্ধ্যায় সিইসির অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করা নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে চতুর্থ ধাপে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেন। সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, অনিয়ম দেখতে পেলে তাদের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। এটাকে বিচারিক ক্ষমতা বলা ঠিক নয়। সশস্ত্র বাহিনীকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে’ ইসির নির্দেশনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন নির্বাচন কমিশনার। বলেন, সেনাবাহিনীকে কখনো বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হয় না। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরটি ভুলভাবে ব্যাখ্যা হয়েছে। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল পাওয়া দেয়া হয়েছে, এটা সত্য নয়। তাদের ফৌজদারি দণ্ডবিধির (সিআরপিসি) ১৩১ ধারা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এটা বিচারিক ক্ষমতা নয়। এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল মোবারক বলেন, বিশৃঙ্খলা হলে সেনাবাহিনী হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে নিজে দায়িত্ব পালনের জন্য অগ্রসর হবে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবে। কাজে বাধাগ্রস্ত হলে দায়ী ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে শুধু গ্রেফতার করে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করবে।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচন নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে বা ভোট পুনঃগণনা দাবি থাকলে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন সংক্ষুব্ধরা। কারণ নির্বাচনের পর ইসির আর ভোট পুনঃগণনার সুযোগ নেই। অনেকেই না জেনে ইসিতে আসেন এবং সময় ক্ষেপণ করেন। পরে দেখা যায় ট্রাইব্যুনালে যাওয়ারও সুযোগ থাকে না। ভোটগ্রহণের পরে গেজেট প্রকাশের এক মাসের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা যায়।
মতৈক্যের ভিত্তিতে ইসি চলছে : প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের অনুপস্থিতিতে ইসির অবস্থান নিয়ে ব্যাখ্যা তুলে ধরেন আবদুল মোবারক। তিনি বলেন, সিইসি বিদেশে থাকায় ক্ষমতা কাউকে অর্পণ করে দিতে হয় না। চার নির্বাচন কমিশনার রয়েছি। সংখ্যাধিক্যের মতের ভিত্তিতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু আমরা মতৈক্যের ভিত্তিতেই সব করছি, সংখ্যাধিক্যেরও প্রয়োজন নেই। সিইসির অনুপস্থিতিতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে জনমনে ভুল ধারণা দেয়া সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, চতুর্থ দফায় ৯১ উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা চেয়ারম্যান পদে ১ হাজার ১৮৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী ৩৮৯ জন, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৪৮৫ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৩১২ জন। চতুর্থ দফায় ৯১ উপজেলায় মোট ভোটারের সংখ্যা ১ কোটি ৩৮ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬৯ লাখ ৭ হাজার ৯৫৬ জন এবং নারী ভোটার ৬৯ লাখ ৫১ হাজার ৩১২ জন। ৯১টি উপজেলায় মোট ভোটকেন্দ্র ৫ হাজার ৮৮৩টি, আর ভোটকক্ষ ৩৭ হাজার ৩৩৮টি। প্রিজাইডিং অফিসার ৫ হাজার ৮৮৩ জন। সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা প্রতি ভোটকক্ষের জন্য একজন করে মোট ৩৯ হাজার ৫১৬ জন। পোলিং কর্মকর্তার সংখ্যা ৭৯ হাজার ৩২ জন।
নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে ৯১টি উপজেলায় মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী। নির্বাচনের আগে ও পরে মিলিয়ে মোট পাঁচ দিন তারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে রয়েছেন তারা। প্রতি উপজেলায় এক প্লাটুন করে সেনাবাহিনীর সদস্য টহল দিচ্ছেন। পাশাপাশি প্রতি উপজেলায় রয়েছে সেনাবাহিনীর দুই থেকে তিনটি গাড়ি। সঙ্গে সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ও একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। মোবাইল ফোর্স হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণ র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। গতকাল ভোট চলাকালে প্রতি কেন্দ্রে একজন পুলিশ (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার একজন (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার ১০ জন (মহিলা ৪, পুরুষ ৬ জন) এবং আনসার একজন (লাঠিসহ) ও গ্রামপুলিশ একজন করে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ৩৮৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ৯৭ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটও মাঠে রয়েছেন।
এদিকে নির্বাচনের সার্বিক বিষয় দেখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও ইসি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল কাজ করছে। আজ সোমবারও এ সেল কাজ করবে। এ ছাড়া এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চলছে সার্বক্ষণিক মনিটরিং। সাংবাদিক, দেশীয় এনজিও এবং বিদেশি পর্যবেক্ষকরা এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন।