কোন লুকোচুরি নেই। নেই কোন ভয়ভীতি। সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পরমুহূর্তে দেখা গেল অনেক কেন্দ্রের ভোট বাক্স ভরে গেছে। অনেক ভোটার ঘুম ভেঙে চোখমুখ ধুয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে দেখেন ভোট দেয়া হয়ে গেছে। জাল ভোটের ভয়ে যারা প্রত্যুষেই কেন্দ্রে হাজির তাদের চোখ চড়কগাছ। বুথে প্রবেশ করা মাত্রই বলা হলো, দাদু কষ্ট করে এলেন কেন? আপনার কাজটি আমরাই করে দিয়েছি। তাহলে ভোট হলো কখন? ভোট হয়েছে মধ্যরাতে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী গোলাম মর্তুজার পক্ষে প্রশাসন, দলীয় কর্মী সবাই মিলেমিশে মধ্যরাতে ভোট দেয়ার কাজ শেষ করেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, প্রিজাইডিং অফিসাররাও এ কাজে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। আগৈলঝাড়া উপজেলা সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত এমপির বাড়ি। ফলে এখানে প্রশাসন কখনওই টুঁ শব্দটি করে না। এখানে আইন মানে হাসানাত।
আর এ কারণেই মধ্যরাতে এবার ভোট উৎসব হয়েছে আগৈলঝাড়ার বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে। ছোটবাসাইল, বাটরা, রাঙতা, ভেলুহাট, বদরাবাদ, বাড়পাইকা মোল্লাপাড়া, গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় আশকর, পশ্চিম বাগধা, নগরবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। সকাল ৯টার মধ্যেই বুথ ভরে গেছে ভোটে। সাংবাদিক ননীগোপাল জানান, ৩৮টি কেন্দ্রেই একই চিত্র। আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী গোলাম মর্তুজা খানের পক্ষে জয়জয়কার। কয়েকটি কেন্দ্রে গণসিল মারা হয়। তবে বেশির ভাগ কেন্দ্রে সকাল ৯টার মধ্যে সব শেষ। সেনাবাহিনী সাড়ে ৯টায় কয়েকটি কেন্দ্রে উপস্থিত হয় তখন বাকি ছিল না কিছুই।
সকালে উপজেলা সদরের আগৈলঝাড়া বিএইচপি একাডেমি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের প্রতিটি বুথে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী গোলাম মোর্তুজা খানের সমর্থকরা ব্যালট পেপারে সিল মেরে তা বাক্সে ভরছেন। এ সময় পোলিং অফিসারদের চুপচাপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বকতিয়ার উদ্দিন বলেন, কেন্দ্রের নয়টি বুথের প্রতিটিতে ২০০টি করে ব্যালট পেপার পোলিং অফিসারদের সরবরাহ করা হয়েছে। ভোট শুরু হওয়ার পর প্রথম আধা ঘণ্টায় সব ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে। কেন্দ্রটির মোট ভোট ২৮৭৮টি। প্রথম আধা ঘণ্টায় বাক্সে ভোট পড়ে ১৮০০টি।
এদিকে বিস্ময়কর এ ভোট বাতিল করে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এস এম আফজাল এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী যতীন্দ্র নাথ মিস্ত্রি। আগৈলঝাড়া প্রেস ক্লাবে সকাল ১০টায় এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান। বানারীপাড়ায় দুপুরে ভোট বর্জন করেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী শাহ আলম।
সোমবার অর্ধবেলা হরতাল
চতুর্থ দফার উপজেলা নির্বাচনে বরিশালের আগৈলঝাড়াতে ভোট কারচুপিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ বিএনপি সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এসএম আফজাল হোসেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও বহিষ্কৃত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যতীন্দ্র নাথ মিস্ত্রি, গিয়াস খান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি রফিকুন্নবী ভাট্টিসহ চার চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৭ প্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন। প্রতিবাদে বিএনপির সোমবার উপজেলায় অর্ধদিবস হরতালের ডাক দিয়েছে। নির্বাচনী আচারণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে থানা পুলিশ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সাত জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
১৯ দলের সমর্থিত প্রার্থী ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এসএম আফজাল হোসেন সকাল ১১টায় আগৈলঝাড়া প্রেস ক্লাবে বলেন, সরকারদলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী গোলাম মোর্তুজা খানের (আনারস) বহিরাগত ক্যাডাররা শনিবার রাতে তার সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। গতকাল ভোট গ্রহণ শুরুর পর পর তাদের এজেন্টদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। এ ছাড়া ভোটারদের ব্যালট ছিনিয়ে নেয়া, ভোট কারচুপি, বিএনপির সমর্থিত ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়া, ভোটকেন্দ্রে নিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্বসহ এ ছাড়া নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়। পুনঃনির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন বর্জনকারী প্রার্থীরা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিকট লিখিত আবেদন করেছেন।
একই ভাবে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও বহিষ্কৃত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যতীন্দ্র নাথ মিস্ত্রি, আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস খান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান প্রার্থী মুফতি রফিকুন্নবী ভাট্টি, বিএনপি সমর্থিত ভাইস চেয়ারম্যান আবুল মোল্লা, জালাল হোসেন মোল্লা, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর বেপারি পৃথক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ভোট বর্জন করেন। তারা উপজেলার ৩৮টি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানান। রাজিহার মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা পশ্চিম রাজিহার গ্রামের শোভা রানী, সোমর্ত দাস অভিযোগ করেন, তাদের ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে আনারস প্রতীকে সিল মারা হয়। এসএম আফজাল হোসেনের এজেন্ট সুভাষ চন্দ্র মণ্ডল অভিযোগ করে বলেন, তাকে বুথ থেকে মারধর করে বের করে দেয় মর্তুজার সমর্থকরা। অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মর্তুজা খানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ইউসুফ হোসেন মোল্লা বলেন, পরাজয় নিশ্চিত ভেবে তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িছেন।
আগৈলঝাড়া থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন জানান, নির্বাচনী আচারণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশ বাকাল গ্রামের বিনয় বৈরাগী, শৈলেন মালাকার, সঞ্জীব বিশ্বাস, অমল বিশ্বাস, মোল্লাপাড়া গ্রামের সমির চৌধুরী ও অনুপ হালদারকে গ্রেপ্তার করেছে।
উজিরপুরে যেভাবে নির্বাচন
চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছেন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার সেলিম আহম্মেদ। তার সামনেই ব্যালটে সিল মারছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস ফকির। সঙ্গে রয়েছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তারা চারটি মুড়ির ৪০০ ব্যালটে সিল মারেন। সিলমারা ব্যালটগুলোর মধ্যে ৩০০ ব্যালট বক্সে ঢোকাতেই বুথে উপস্থিত হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা সিল মারা ব্যালটগুলো সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের সামনে রেখেই বুথ ত্যাগ করেন। পরে অবশ্য সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার সেলিম আহম্মেদ নিজেই ব্যালটগুলো বক্সে ঢুকিয়ে দেন।
চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে গতকাল বরিশালের উজিরপুর উপজেলার নির্বাচনের ষোলক ইউনিয়নের ২৯নং ধামুরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে সরজমিন গিয়ে ২নং বুথে এমন চিত্রই দেখা গেছে। ওই কেন্দ্রের ৩নং বুথে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মর্তুজা আলম খান ব্যালট পেপার সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে দিয়ে দিলে তারা ব্যালট পেপারে নিজেদের দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী হাফিজুর রহমান ইকবালের কাপ-পিরিচ মার্কার ওপর সিল মারে। এ কেন্দ্রে ৩৬২০ ভোটের ২৩২৫ ভোট সকাল সাড়ে ১১টার মধ্যেই কাস্ট হয় বলে জানিয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসার রফিকুল ইসলাম কাজী। তিনি আরও বলেন, সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বাধা দিলে তারা আমাদের লাঞ্ছিত করে। সিল মারার বিষয়টি রিটার্নিং অফিসার দুলাল তালুকদারকে অবহিত করা হয়েছে।
উপজেলার ওটরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রের ২নং বুথে ব্যালটে সিল মারতে দেখা যায় বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য ও সমাজ কল্যাণ বিভাগের সদস্য রুবেলকে। ওই কেন্দ্রের চারটি বুথেই বিএম কলেজ ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে ব্যালটে নিজেদের দলীয় প্রার্থী হাফিজুর রহমান ইকবালের কাপ পিরিচ মার্কার ওপর সিল মারতে দেখা যায়।
এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আনিছুর রহমান মল্লিক জানালেন, এ কেন্দ্রে ১৬৪৯ ভোটের ১০৭৬ ভোট কাস্ট হয় সকাল ১১টার মধ্যে। তবে ব্যালটে সরকারদলীয় সমর্থকদের সিল মারার বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রিটার্নিং অফিসারকে অবহিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে উপজেলার ৩২নং রামের কাঠি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৬০০ ব্যালট পেপারে একত্রে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সিল মারেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি রবিউল তালুকদার। তবে সিলমারা ৪০০ ব্যালট পেপার বক্সে ঢোকালেও বাকি ২০০ ব্যালট পেপার সেনাবাহিনী গিয়ে উদ্ধার করে। প্রিজাইডিং অফিসার নির্মলেন্দু হালদার সেনাবহিনীর সদস্যদের সামনেই ওই ২০০ ব্যালট পেপার বাতিল করেন। এ কেন্দ্রের ২৯৩৬ ভোটের ১৭২৫ ভোট পৌনে ১২টার মধ্যেই কাস্ট হয়েছে বলে জানান তিনি।
উপজেলার বরাকোঠা দরগাবাড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হাফিজুর রহমান ইকবালের সমর্থকরা বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মাজেদ তালুকদারের নির্বাচনী এজেন্টদের বুথ থেকে বের করে দিরে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
উপজেলার জিজি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, আ. মজিদ মহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, ডব্লিউবি ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন কেন্দ্র, পরামানন্দ সাহা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, আ. শহীদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র ও যোগির কান্দা মাধ্যমিক বিদ্যায়ল কেন্দ্রসহ উপজেলার ১৭টি কেন্দ্রে সরজমিন গিয়ে একই চিত্র দেখা যায়। দুপুর ১২টার মধ্যে অধিকাং কেন্দ্রের ৭০ ভাগ ভোট কাস্ট হয়েছে।
রিটার্নিং অফিসার মো. দুলাল তালুকদার জানান, বেশ কয়েকটি কেন্দ্র থেকে এ ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে। তবে ওই সব কেন্দ্রে তাৎক্ষণিকভাবে স্ট্রাইকিং ফোর্স গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।
বানারীপাড়ায় একযোগে কেন্দ্র দখল
বানারীপাড়ায় ভোট শুরু হওয়ার পর তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ভোটকেন্দ্রগুলোতেও ছিল ভোটারদের ভিড়। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় সকাল ১০টায়। উপজেলার সবগুলো কেন্দ্রে এ সময় দখলে নেয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। প্রতিটি কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয় প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের এজেন্টদের। এরপর মাত্র ১ ঘণ্টায় সিল মেরে বাক্স ভরাট করা হয়। দুপুরে এ ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী শাহ আলম মিয়া নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।