হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা। চতুর্থ ধাপের নির্বাচন শেষে ৯০টি উপজেলার বেসরকারী ফলাফলে এটা প্রমানিত হয়েছে। সরকারী দলের এই তুমুল জনপ্রিয়তার তোড়ে ভেসে গেছে প্রথম দুই দফার উপজেলা নির্বাচনে পাওয়া বিএনপির সাফল্য। কারণ আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা এবার বিএনপির চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি উপজেলায় বিজয়ী হয়েছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় দফার উপজেলার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেকটা এগিয়েই ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়া বিএনপি নের্তৃত্বাধীন জোট। তৃতীয় দফায় বিএনপির চেয়ে বেশি উপজেলায় বিজয়ী হয় ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীরা। ব্যবধান অবশ্য তেমন আকাশ-পাতাল ছিল না। কিন্তু চতুর্থ দফার উপজেলা নির্বাচনে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে আওয়ামী লীগ।
৯০ টি উপজেলার বেসরকারি ফলাফলে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা যেথানে ৫৩টি উপজেলায় বিজয়ী হয়েছে, সেখানে বিএনপি প্রার্থীরা জয় পেয়েছে ২৫ টি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরীক জামায়াতের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে ৪ উপজেলায়। স্বতন্ত্রসহ অন্যরা জয় পেয়েছে ৮ উপজেলায়।
এর আগে প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ৯৭ উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয় ৩৫টিতে। বিএনপি প্রার্থীরা এককভাবে ৩৮টি উপজেলায় বিজয়ী হয়। জামায়াতের ১২টি ধরে ১৯ দলীয় জোটের প্রার্থী বিজয়ী হয় ৫০টি উপজেলায়। প্রথমধাপের নির্বাচনে এককভাবে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ কম পায় ৩টি আর জোটগতভাবে ১৫টিতে।
দ্বিতীয় ধাপে ১১২ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ জয় পায় ৪৩ টিতে। বিএনপি বিজয়ী হয় ৫১টিতে। জামায়াত জয়ী হয় ৮টিতে। এক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে এককভাবে আওয়ামী লীগ কম পায় ৮টি আর জোটগতভাবে ১৬ টি।
এরপর তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ৮০ উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ৩৭ টিতে। এতে বিএনপি বিজয়ী হয় ৩০টিতে। জামায়াত প্রার্থীরা জয় পায় ৭টিতে। এ পর্যায়ে এককভাবে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে কম পায় ৭টি। জোটগত হিসেবে ফলাফল থাকে সমান সমান।
রোববার অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের উপজেলা নির্বাচনে অবিস্মরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। এককভাবে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে বেশি জয় পেয়েছে ২৮টিতে। জোটগতাবে বেশি জয়ী হয়েছে ২৪টি উপজেলায়।
সাধারণ মানুষ তো বটেই, খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছেও এই সাফল্য অনেকটা অভাবনীয়। ক্ষমতাসীন দলের এ সাফল্য নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে নানা বিশ্লেষণ।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রথম ধাপের নির্বাচনে দু’একটি জায়গায় কেন্দ্র দখল ও ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠলেও সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনা তেমন ঘটেনি। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, হামলাসহ নানা অনিয়ম এবং সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ধাপের নির্বাচনে সহিংসতায় নিহত হন ১ জন। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় নিহত হয় ৩ জন। এই পর্বে কেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাঁধা দেয়া, জালভোট প্রদান বেড়ে যায় উল্লেখ করার মতোই।
রোববার অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই আর অনিয়ম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ভোট শুরুর আগেই কেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, ব্যালট ছিনতাই করে বাক্স বোঝাই, নির্বাচন শুরুর একঘন্টা হতেই ভোট শেষ বলে ভোটারদের ফিরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে বহু উপজেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কেন্দ্রে। এ নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতায় নিহত হয়েছে চারজন। আহত হয়েছেন কয়েকশ।
চারপর্বের উপজেলা নির্বাচনের এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সংঘাত-সহিংসতা আর নানা অনিয়মের ঘটনা ধাপে ধাপে বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে আওয়ামী লীগের সাফল্য। এই চিত্রটি ক্ষমতাসীদের জন্য মোটেও সুখকর হতে পারে না।
বিএনপি বরাবরই অভিযোগ জানিয়ে আসছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দলটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এই নিয়ে অসন্তোষ আর হতাশা ছিল বিএনপির তৃণমূলে। সেই হতাশা কাটাতেই দলটি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়। সন্দেহ ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে। ধাপে ধাপে উপজেলা নির্বাচনে যেভাবে অনিয়ম আর সহিংসতা বাড়ছে, এতে করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের অভিযোগ শক্ত ভিত্তি পাচ্ছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূণ বিষয় হলো, অনিয়ম-সহিংসতা আর হতাহতের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ক্ষমতাসীন দলের সাফল্য বেড়ে যাওয়া। এটি ভীষণ দৃষ্টিকটু।
প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচন হয়েছে ১৯ ফেব্রুয়ারি আর চতুর্থ ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ২৩ মার্চ। এই ৩৩ দিনের ব্যবধানে সরকার এমন কোনো যুগান্তকারী সাফল্য ঘটায়নি যে, একলাফে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন বেড়ে যাবে দ্বিগুনের চেয়েও বেশি।
এসব বিষয় দেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে বিশেষ কোনো বার্তা। অবশ্য জাতীয় নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে নির্বাচিত হয়ে গঠন করা সরকারের কাছে সত্যিকারের জনমত গুরুত্ব না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।