সাবধান, রাজধানীতে পুলিশ ও র্যা ব বেশে ভয়ঙ্কর অপরাধীচক্র

0
161
Print Friendly, PDF & Email

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশ-র‌্যাব বেশে ভয়ঙ্কর অপরাধীচক্র। শিকার খুঁজতে রাজপথে মাইক্রোবাসের ভেতর বসে থাকা এই চক্রের হাতে থাকে অস্ত্র, ওয়াকিটকি ও মোটা লাঠি। তাদের ভাবভঙ্গিও অনেকটা পুলিশ-র‌্যাব সদস্যের মতো। ব্যস্ততম সড়কে গাড়ির গতিরোধ করে তারা তল্লাশির নামে শিকার ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে অপহরণ করছে। অপহৃতদের কখনো খোঁজ মেলে দুর্গম কোনো এলাকায়, আবার অনেকের লাশও খুঁজে পাওয়া যায় না।
এদিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসন ওই চক্রকে চিহ্নিত করার নতুন কৌশল খুঁজছে। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনায় কোনোভাবেই যেন র‌্যাব-পুলিশের কোনো সদস্য জড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পুলিশের পোশাক, হ্যান্ডকাপ ও জ্যাকেটসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি খোলা বাজারে বিক্রি হওয়ার সুযোগে সংঘবদ্ধ একটি চক্র এসব জোগাড় করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করছে। যার দায় পুরোটাই তাদের ঘাড়ে চাপছে। তবে কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অর্থলোভে পড়ে এ দলে ভিড়ছে বলেও ওই কর্মকর্তা জানান।
জানা গেছে, রাজধানীতে অপহরণের বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। এমনই একটি ঘটনায় অপহরণ হন গুলশানের ব্যবসায়ী রিয়াদ। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক গুলশান-তেজগাঁও লিঙ্ক রোডে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামিয়ে তাকে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ বেশে অপরাধীচক্র। ঘটনার দুই দিন পর মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে তাকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ওই দুই দিনে তার ওপর চালানো হয়েছে, অমানুষিক নির্যাতন। রিয়াদ এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি, তাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, কিংবা তারা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, নাকি সংশ্লিষ্টরা ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধীচক্র।
সম্প্রতি র‌্যাব পরিচয়ে অপরাধীচক্র ধরে নিয়ে যায় আরো এক যুবক মহিউদ্দিন আহাদকে। তার পিতা আবুল হোসেন জানান, গত ৬ মার্চ মিরপুর-১ নাম্বার থেকে র‌্যাব-পুলিশ পরিচয়ে একটি চক্র আহাদকে ধরে নিয়ে যায়। পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা আহাদের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। আহাদ গুলশান-২ এর এসএস ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি দোকানে কাজ করতেন। তাকে পুলিশ বেশে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি প্রশাসনের কাছে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করেও কোনো সুফল পাননি বলে জানান।
অন্যদিকে, এক মাস পেরিয়ে গেলেও সন্ধান মেলেনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে অপহৃত ব্যবসায়ী আবুল হাসনাত পলিনের (৪০)। ছেলের শোকে কাতর বৃদ্ধ মা। স্বামীকে হারিয়ে পাগল প্রায় পলিনের স্ত্রী। বাবার জন্য সারাক্ষণ কাঁদছে তার স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তান।
পলিনের বড় ভাই মো. মুরাদ হোসেন জানান, গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টার দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টসংলগ্ন বিএএফ শাহীন কলেজের সামনে থেকে সাদা পোশাকের লোকজন পলিনকে অপহরণ করে। ছেলেকে স্কুলে দিয়ে বের হওয়ার সময় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাকে (খুলনা মেট্রো চ-৫১-২১৯০) মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ঢাকা সেনানিবাসের মতো স্পর্শকাতর এলাকা থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন ব্যবসায়ী অপহরণ হয়ে গেল। কিন্তু প্রশাসন এক মাসেও কোনো কূলকিনারা করতে পারল না।
মুরাদ আরো বলেন, র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয় এবং বিভিন্ন থানায় যোগাযোগ করেও কোনো সন্ধান মেলেনি তার ভাই পলিনের। ঘটনার দুই দিন পর কাফরুল থানায় একটি মামলাও করা হয়। পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মন্ত্রীর কথামতো র‌্যাবের মহাপরিচালক ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তেমন কোনো লাভ হয়নি। এত কিছুর পরও পলিনের সন্ধান না পেয়ে ২ ও ৩ মার্চ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় পলিনের ছবিসহ বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। মামলাটি তদন্তের দায়িত্বে ছিল র‌্যাব। কিন্তু কয়েকদিন আগে তদন্তভার পড়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর।
এদিকে, গত বছর ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে ধোলাইখাল এলাকার ব্যবসায়ী পারভেজকে পুলিশ বেশে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে যায়। তার লাশ তিন দিন পর বুড়িগঙ্গা পানগাঁও এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। চলতি বছর ১৩ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ী থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন ওষুধ ব্যবসায়ী রাকিবুল ইসলাম। অপহৃত রাকিবুলের পরিবার জানতে পারে তাকে ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তার পরিবারের লোকজন ডিবি অফিসে গিয়ে তার কোনো সন্ধান পাননি। দুই দিন পর তাকে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করা হয়। গত বছর নভেম্বর মাসে বাসা থেকে পাওনা টাকা আদায় করার জন্য বের হয়ে নিখোঁজ হন পল্লবীর মাছ ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। পরদিন খলিলের সন্ধান চেয়ে বড় ভাই বাচ্চু মিয়া পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ভাইয়ের জীবিত সন্ধান চেয়ে পুলিশের কাছ থেকে আইনি সহায়তার জন্য বারবার ধর্ণা দিলেও কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু খলিলের নিখোঁজ রহস্যের ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। অবশেষে ৭ দিন পর ড্রেন থেকে খলিলের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে এ ধরনের বেশ কিছু প্রতারকচক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় অপহৃত বা নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনদের মোবাইলে ফোন দিয়ে চাঁদা দাবি করে থাকে অপহরণকারীরা। রাজনৈতিক নানা কর্মসূচিতে রাজপথে পুলিশের যখন ধরপাকড় শুরু হয়, ঠিক তখনই এ সুযোগে কাজে লাগিয়ে অপরাধী চক্র রাজপথে থেকে প্রকাশ্যে কাউকে মাইক্রোবাসে তুলে নিলে, পুলিশ বা র‌্যাব ভেবে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে না। এ ধরনের অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের শেকড়ের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। তিনি আরো বলেন, ৩৫ বছর বয়সী ব্যবসায়ী এটিএম রিয়াাদ গত ২৩ নভেম্বর বিকালে অপহৃত হন। তাকে দুই দিন পর অর্ধমৃত অবস্থায় কালিয়াকৈর-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশের একটি ঝোপঝাড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় । এ ছাড়া ধানম-ি থেকে একইভাবে অপহৃত হওয়া আরেক যুবককে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে তার স্বজনরা।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবির যায়যায়দিনকে বলেন, গত ৯ মার্চ রাতে পাঁচটি অস্ত্রসহ সংঘবদ্ধ অপহরণকারীচক্রের প্রধান জুনায়েদ নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে পুলিশের পোশাক, ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ, অস্ত্র, ২৭ রাউন্ড গুলি, ৪টি পেট্রলবোমা, ধারাল ছোরাসহ বিভিন্ন পশুর চামড়া উদ্ধার করা হয়। জুনায়েদ অভিনব কৌশলে গাড়ি ছিনতাই ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করেছে।
তিনি আরো জানান, মহাখালীর আরজতপাড়া এলাকায় কড়াইল বস্তির অপরাধীদের সবার সঙ্গে যোগসূত্র থাকা জুনায়েদের রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। বিশেষ করে তার দলে রয়েছে কিলার গ্রুপ। সে দামি গাড়িতে লোকদের জোর করে উঠিয়ে নিয়ে পরিবারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে আসছিল। এমনকি আফসারা নামে তার মেয়েকে টার্গেট করা ব্যক্তির পেছনে লেলিয়ে দিয়ে জোর করে নগ্ন ছবি তুলে কৌশলে বড় দাগের অর্থ হাতিয়ে নিত। রাজধানীতে এই ধরনের চক্রকে চিহ্নিত করে নতুন কৌশল ব্যবহার করে তাদের ধরার চেষ্টা চলছে।

শেয়ার করুন