নগর কাণ্ডারী হিসেবে সাদেক হোসেন খোকা এবং ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালামের বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না বিএনপি। খোকা আহ্বায়কের পদ থেকে সড়ে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়ার পর দলের মধ্যে নানা আলোচনা থাকলেও তাতে কূল-কিনারা মিলছে না। নতুন কমিটির দায়িত্বও যে তারা পাবেন এ বিষয়ে কর্মীরা মোটামুটি নিশ্চিত।
তবে দায়িত্ব যারাই পান না কেন নগর রাজনীতিতে আরেক প্রভাবশালী নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকার মধ্যে ঐক্যমত ছাড়া যে এখান থেকে সুফল পাওয়া যাবে না এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
এই দুই নেতার মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক না থাকায় গোটা দলকে খেসারত দিতে হচ্ছে। তাই নগরের হ-য-ব-র-ল কাটিয়ে উঠতে মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকার ঐক্যমত হওয়া জরুরী বলে মনে করছেন নগরের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। আর এ জন্য চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্যোগী এবং আরো আন্তরিক হতে হবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘একে অপরকে দোষারোপ না করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
মহানগরের দায়িত্বের জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর নাম প্রস্তাব করলেও তারা এ দায়িত্ব নিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন বলে খোকা জানিয়েছেন।
নগরের নতুন কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে দুই জন স্থায়ী কমিটির নাম শোনা যাচ্ছে। তার একজন আ স ম হান্নান শাহ’র দায়িত্ব নিতে আপত্তি না থাকলেও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বাংলামেইলকে বলেছেন, ‘আমরা যাবো কেন? তরুণদের নেতৃত্বে আনতে হবে।’
তবে স্থায়ী কমিটির অর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলামেইলকে বলেছেন, ‘ঢাকার রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির দূরত্ব নেই বললেই চলে। এখানে তরুণদের নেতৃত্বে আনলে তারা কী করবে? জাতীয় রাজনীতিতে তারা তো একদমই অদক্ষ।’
নগরের নতুন কমিটি নিয়ে আবু সাঈদ খোকন, আমান উল্লাহ আমান, মো. শাহজাহান, বরকত উল্লাহ বুলু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আবুল খায়ের ভূঁইয়া, যুব দল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর নেতা ‘দৌড়’ সালাহউদ্দিন আহমেদ, মহানগর নেতা কাজী আবুল বাশার ও এম এ কাইয়ুমের নাম আলোচনায় রয়েছে।
ঢাকা মহানগর বিএনপির একজন কর্মী বাংলামেইলকে বলেন, ‘উড়ে এসে জুড়ে বসে অন্য কিছু করা গেলেও ঢাকার নেতৃত্ব দেয়া যাবে না। এখানে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব তৈরির জন্য স্থানীয়দের প্রাধান্য দিতে হবে। ওয়ার্ড-ইউনিট থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই নীতি অনুসরণ করতে হবে।’
মহানগর কমিটি নিয়ে গণমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে তাতে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে দাবি করে অপর একজন বিএনপি কর্মী বাংলামেইলকে বলেন, ‘মির্জা আব্বাসের দাদার বাড়ি কিশোরগঞ্জে হলেও তার বাবা ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। মির্জা আব্বাস ঢাকার মেয়র ছিলেন। অনুরূপ সাদেক হোসেন খোকাও ঢাকার মেয়র ছিলেন। পাশাপাশি মহানগরের দায়িত্বে ছিলেন প্রায় দেড় যুগ। আবদুস সালামের আদি নিবাস কিশোরগঞ্জ হলেও তিনি ঢাকার ডেপুটি মেয়র ছিলেন। এই নেতাদের নিয়ে তীব্র সমালোচনা থাকলেও সব পর্যায়ে তাদের অনুসারীদের প্রভাব রয়েছে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে হবে।’
বিএনপি কর্মী বলেন, ‘নিজের ঘর সামলাতে হিমশিম খেয়ে ঢাকায় এসে যারা মেহমানদারি গ্রহণ করেন। তারা যদি নেতৃত্ব দিতে যায় তাহলে তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। ঢাকায় এতদিন ছিল দুই পক্ষ তাতেই বিএনপি কাবু। আর মেহমানরা আসলে হবে ৩ পক্ষ। দুই পক্ষ থাকাকালে এক পক্ষ অপর পক্ষকে সহযোগিতার বদলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। আর মেহমানদের কপালে কী আছে তা সময়ই বলে দেবে।’
তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে ঢাকায় এসে বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়া আর ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব দেয়া এক নয়।’
ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার মকবুল আহমেদ টিপু বাংলামেইলকে বলেন, ‘বাইরের নেতা দিয়ে ঢাকা মহানগর চালানো কীভাবে সম্ভব? আমাকে যদি কোনো মফস্বল থানার দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে আমি কী করতে পারবো? বাইরের কেউ এসে তো আমাদের সঙ্গে মিশতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমার মতে মন্দের ভালো খোকা ভাই। তিনি অত্যন্ত ম্যানেজেবল লোক। শুনেছি আব্বাস ভাইকে দায়িত্ব নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তিনি দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। নিজেদের শক্তি অপচয় না করে মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকার ঐক্যমতের বিকল্প নেই।’
মির্জা আব্বাসের অনুসারী হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু বাংলামেইলকে বলেন, ‘ঢাকা মহানগর কমিটি গঠনের জন্য একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। এটাকে সাধুবাদ জানাই। ১৯৮৪-৮৫ সালে বিএনপির দুঃসময়ে মির্জা গোলাম হাফিজ ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তখন তাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। আমার প্রত্যাশা আগামী ৩ মাসের মধ্যে ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে মহানগর কমিটি গঠন করা হবে। নতুন নেতৃত্বের সুযোগ দিতে হবে। সাদেক হোসেন খোকা সড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এখন ৯০’র গণআন্দোলন এবং ১/১১ তে যারা দলের জন্য কাজ করেছেন তাদের জায়গা দিতে হবে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির সঙ্গে যাদের পরিচিতি আছে তাদের সুযোগ দিতে হবে।’
জানা গেছে, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং আমান উল্লাহ আমানকে নিয়ে দলের মধ্যে প্রবল সমালোচনা রয়েছে। এই দুই নেতার মধ্যেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিএনপি জোটের ডাকে যখন দেশব্যাপী টানা অবরোধ চলছিল সেই সময় কেরাণীগঞ্জের সরকার দলীয় এমপির সঙ্গে এক টেবিলে বসে গয়েশ্বর রায়ের ভুরি ভোজনের একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধেও আঁতাতের অভিযোগ রয়েছে। বরকত উল্লাহ বুলুর প্রতিও অনেকের সন্দেহ রয়েছে। বিশেষ করে ১/১১ এর প্রেক্ষিতে তার ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে নিয়েও অস্বস্তি কম নেই। তার বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্য,জামায়াত-শিবির প্রীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।