‘দুর্নীতির দুই মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর নয় আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।’ দুর্নীতি দমন কমিশনের অন্যতম আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল ও মীর আহমেদ আলী সালাম বর্তমানকে এ কথা বলেন।
বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ-৩ আদালত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুটিতে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় অভিযোগ গঠন করে আদালত।
দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী হিসেবে তার পদমর্যাদার বলে অথবা ব্যাংকার, ব্যবসায়, দালাল, অ্যাটর্নি বা প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবসা সূত্রে কোনোভাবে কোনো সম্পত্তির জিম্মাদার হয়ে বা উক্ত সম্পত্তি পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত হয়ে সেই সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করে তবে উক্ত লোক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধারার অপরাধ আমলযোগ্য, অজামিনযোগ্য এবং মীমাংসাযোগ্য নয়।
দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় বলা হয়েছে, দুষ্কর্মে সহায়তা করা হয়েছে, সহায়তার দরুন সেই কার্য সম্পাদন হয়ে থাকলে এবং সেই ক্ষেত্রে দণ্ডদানের কোনো স্পষ্ট বিধান না থাকে, তবে অনুরূপ সহায়তাকারী যে অপরাধ সংঘটনের সহায়তা করেছেন সেই অপরাধের জন্য যে দণ্ডের বিধান করা হয়েছে অপরাধটি সংঘটনের সহায়তার জন্য তাকে সেই দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। অর্থাত্ সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন এবং সর্বনিম্ন ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, ‘দুদক আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এ দুটি মামলায় খালেদা ও তারেকসহ নয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় আদালত। আদালত সেই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে। আগামী ২১ এপ্রিল সাক্ষ্যগ্রহণের শুনানি হবে।’
সালাম আরও বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হব আমরা। মামলা প্রমাণের জন্য সব ধরনের কাগজপত্র সাক্ষ্যগ্রহণের শুনানির সময় আদালতে উপস্থাপন করব। আশা করি, এ দুটি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে। সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ অপরদিকে খালেদা ও তারেকের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া গতকাল বর্তমানকে বলেন, ‘আইন মেনে আদালত অভিযোগ গঠন করেনি। আসামিদের জিজ্ঞাসা না করেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ গঠনের আদেশের বিষয় পনুর্বিবেচনার আবেদন করব। মামলার দায় হতে আসামিদের অব্যাহতি দেয়ার জন্য আবেদন করা হবে।’
সানাউল্লাহ আরও বলেন, ‘অব্যাহতির আবেদন খারিজ হলে মামলার কার্যক্রম বাতিলের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করব। আইন অমান্য করে অভিযোগ গঠন করার কারণে আদালতের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে অভিযোগ দাখিল করব। আর অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবে না দুদক।’
খালেদার অপর আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘আসামিদের জিজ্ঞাসা না করে অভিযোগ গঠন করে আদালত নজিরবিহীন ঘটনার অবতারণা করেছেন। খালেদাসহ অপর আসামিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য আসামিদের বিরুদ্ধে এ মামলা করে দুদক। আসামিরা কোনো দুর্নীতি করেনি।’
মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, দুর্নীতির দুটি মামলারই আসামি খালেদা জিয়া। এছাড়া আসামিদের মধ্যে রয়েছেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তারেক রহমান, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও মমিনুর রহমান এবং মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আসামিরা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তত্কালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
মামলার শুরু থেকে পলাতক আছেন হারিছ চৌধুরী, কামাল সিদ্দিকী ও মনিরুল। শরফুদ্দিন আদালতে হাজির হননি। বাকি আসামিরা জামিনে আছেন। তারেক রহমান আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বলা হয়, এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশে একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাত্ করেন আসামিরা। এ মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ মামলাটি তদন্ত করে ২০১০ সালের ৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
অপরদিকে জিয়া ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বলা হয়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানম নামক এক মহিলার কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। তবে জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেয়া হয়েছে, যা কাগজপত্রে উল্লেখ করা হয়। এই টাকার বৈধ কোনো উত্স ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ। এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ চারজনকে অভিযুক্ত করে ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ খান।