জিততে মরিয়া আওয়ামী লীগ

0
110
Print Friendly, PDF & Email

চলমান উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের মতো চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপেও জিততে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দল সমর্থিত প্রার্থীদের জেতাতে ভোটব্যাংকের চেয়ে প্রশাসনের ওপরই বেশি ভরসা করছে ক্ষমতাসীনেরা। প্রথম দুই ধাপে ভোটারদের ওপর আস্থা রাখায় চরম বিপর্যয় ঘটে শাসক দলের প্রার্থীদের। ওই বিপর্যয় কাটাতে তৃতীয় ধাপে কৌশল পরিবর্তন করে বিরোধী নেতাকর্মীদের প্রশাসনিকভাবে হয়রানি ও ভোটকেন্দ্র দখলসহ ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রার্থীর জয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করছেন, বাকি দুই ধাপে একই কৌশল অবলম্বন করলে ফল পক্ষে আসবে। অন্যথায় আবারো বিপর্যয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই কৌশল সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, হত্যাচেষ্টা, মিথ্যা মামলায় আসামি, গ্রেফতার ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিরোধী জোটের প্রার্থী ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন সরকার সমর্থক নেতাকর্মীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার-হয়রানির মাত্রা বৃদ্ধি, বাড়ি বাড়ি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের পাঠিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে ভয়ভীতি দেখানো, চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দেয়া ও সরকার সমর্থক নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে জালভোট দিতে সহযোগিতা করায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে এখন বাকি নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার চিন্তা করছে আওয়ামী লীগ। অন্যথায় ভোটারদের ওপর আস্থা রাখতে গেলে বিরোধী দলের পাল্লা ভারী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটকে এই সুযোগটা কিছুতেই দিতে চাচ্ছে না আওয়ামী লীগ।
উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপের ভোট আগামীকাল (২৩ মার্চ) অনুষ্ঠিত হবে। এ দফায় বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের এলাকায় বেশি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৪৩টি জেলার ৯১টি উপজেলার মধ্যে ২২ উপজেলায় প্রভাবশালীদের সমর্থনপুষ্ট প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন ভোটাররা। নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক চাপে রয়েছেন মন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রার্থীদের জেতাতে বিভিন্ন কর্মসূচির অজুহাতে এলাকায় ছুটছেন তারা। তৃণমূলপর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক করে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। প্রথম দুই দফায় দলের ভরাডুবির পাশাপাশি প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের এলাকায়ও হোঁচট খেয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে তৃতীয় দফায় বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে শাসকদল এগিয়ে থাকলেও সেই আগের মতোই প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের উপজেলায় ভরাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে দলের হাইকমান্ড থেকে তিরস্কৃত হয়েছেন ওই মন্ত্রী-নেতারা। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রভাবশালীদের সাথে তৃণমূলের সম্পর্কের টানাপড়েন, অহঙ্কার-দাম্ভিকতা ও জনবিচ্ছিন্নতার কারণে তাদের প্রার্থীরা ধরাশায়ী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ভোটের মাঠে দলের জনপ্রিয়তা বিএনপি-জামায়াত থেকে কোনো অংশে কম নেই। তবে নেতারা মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তৃণমূলের সাথে যোগাযোগ রাখেন না। এলাকা থেকে কেউ দেখা করতে এলে পাত্তা দেন না। কোনো সমস্যা নিয়ে গেলে সমাধান করেন না। তৃণমূলের নেতারা ও এলাকার জনগণ এই ক্ষোভ ঝাড়েন ভোটের মাঠে। নেতারা আরো জানান, ভোটারদের ওপর ছেড়ে দিলে আগের মতোই পুনরাবৃত্তি হবে। তাই কেউই আস্থা রাখতে পারছেন না ভোটারদের ওপর। পরাজয় হলে প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের মানসম্মান ও দলে তাদের অবস্থান নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। অন্তত এই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তারা।
এবার নির্বাচন হচ্ছে আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া নেতা ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নিজ উপজেলা ভোলার দৌলতখান, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর নির্বাচনী এলাকা ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সিলেট সদর, দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উপজেলা শেরপুরের নালিতাবাড়ি, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর উপজেলা টাঙ্গাইলের কালিহাতী, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর নিজ উপজেলা পাবনার ঈশ্বরদী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর উপজেলা মৌলভীবাজার সদর, প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হকের উপজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের উপজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের উপজেলা চট্টগ্রামের আনোয়ারা, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেকের উপজেলা যশোরের কেশবপুর, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর, বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা ভোলার মনপুরা উপজেলা, বর্তমান সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের উপজেলা পটুয়াখালীর বাউফল, হুইপ আতিকুর রহমান আতিকের শেরপুর সদর, সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের উপজেলা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়ার উপজেলা পটুয়াখালী সদর, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকা রাজশাহীর তানোর, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর উপজেলা দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর উপজেলা বরিশালের আগৈলঝাড়ায়।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা জানান, গত তিন ধাপের চেয়ে চতুর্থ ধাপে একটু ভিন্ন কৌশলে এগোতে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এই ধাপে দলের বেশিসংখ্যক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতাদের এলাকায় নির্বাচন হচ্ছে। ওই এলাকায় দল সমর্থিত প্রার্থী হেরে গেলে তাদের একটা প্রেস্টিজ নষ্ট হবে। দলের হাইকমান্ড থেকে তাদের তিরস্কার করা হয়। এ জন্য প্রেস্টিজ রক্ষার্থে হাইকমান্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রার্থীদের জোতাতে যেকোনো পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। ওই নেতা আরো জানান, বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংসতায় ম্লান হয়েছে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই অনেকটা ‘জনবিচ্ছিন্ন’। তার পরেও বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়ে এলাকায় ছুটছেন তারা, তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীদের একত্র করে প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা দেখে ভোটারেরা ভোট দিয়ে থাকে। এতে যেকোনো দলের সমর্থিত প্রার্থীরা জিততে পারে। তিনি বলেন, আধিপত্য বিস্তার ও প্রাধান্য বজায় রাখতে গেলে সহিংসতা হয়। সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে সহিংসতা এড়াতে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

শেয়ার করুন