নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উদাসীনতার কারণে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্র সীমানা সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমার এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্লকে তাদের অনুসন্ধান কাজ শেষ করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ওই অংশে কোনো কাজই শুরু করতে পারেনি। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্র সীমানা সংলগ্ন মিয়ানমার অংশে ব্লক এডি-৭ এ ১০ মার্চ ত্রিমাত্রিক জরিপ কাজ শেষ করে। মিয়ানমার এ ব্লকে ত্রিমাত্রিক জরিপ কাজ শুরু করেছিল ১০ জানুয়ারি। মিয়ানমারের এডি-৭ ব্লক সংলগ্ন বাংলাদেশের ১১ নম্বর ব্লকে জরুরি ভিত্তিতে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক জরিপ কাজ করার অনুরোধ জানিয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোঃ খুরশেদ আলম। কিন্তু দেড় মাস এ চিঠি পড়ে থাকার পর ১৯ মার্চ পেট্রোবাংলাকে চিঠি দেয় জ্বালানি বিভাগ। একই বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব খাদিজা নাজনীন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিষয়টি সম্পর্কে সাত দিনের মধ্যে মতামত দেয়ার জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি হওয়া সত্ত্বেও জ্বালানি বিভাগ দেড় মাস ধরে এ চিঠি ফেলে রেখে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন না হওয়ার কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া এ চিঠির গুরুত্ব বুঝতে পারেনি, তাই দেরি হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোঃ খুরশেদ আলম এ প্রসঙ্গে আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্র সীমানালাগোয়া তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ব্লকগুলোতে কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। কারণ এরই মধ্যে মিয়ানমার তাদের অংশের ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান কাজ জোরদার করেছে। এ কারণে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মিয়ানমার এডি-৭ ব্লকে ত্রিমাত্রিক জরিপ কাজ চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এ ব্লকটি বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২০০৮ সালে মিয়ানমার এ ব্লকের কাছাকাছি ডিলিং রিগ স্থাপনের প্রক্রিয়া গ্রহণ করে এবং এরই মধ্যে সিসমিক সার্ভে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ত্রিমাত্রিক জরিপ কাজ অনেক ব্যয়বহুল হওয়ার পরও ফের এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, এ ব্লকে প্রাকৃতিক গ্যাস বা অন্য কোনো মূল্যবান খনিজ সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মিয়ানমারের এডি-৭ ব্লকটি বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানার খুব কাছাকাছি হওয়ায় তার আশপাশে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় যে কোনো ধরনের খনিজ সম্পদের মজুত থাকতে পারে। এজন্য দ্রুত নিশ্চিত হতে সিসিমিক সার্ভে করা প্রয়োজন। মিয়ানমার এডি-৭ ব্লক থেকে খনিজ সম্পদ উত্তোলন শুরু করলে এবং ব্লকটির আশপাশে অর্থাৎ বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় প্রাকৃতিক গ্যাসের বিস্তৃতি থাকলে তারা বাংলাদেশে অবস্থিত ব্লকের গ্যাস বা অন্য কোনো খনিজ সম্পদ উত্তোলন করে নিয়ে যেতে পারে। তাই ওই ব্লকের আশপাশে বাংলাদেশের সীমানায় খনিজ সম্পদ পাওয়া গেলে তা উত্তোলনের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের এডি-৭ ব্লকটি ও এর আশপাশের এলাকা রাখাইন বেসিন নামে পরিচিত। সমুদ্র সীমানা হচ্ছে রাজনৈতিক সীমানা। কিন্তু সমুদ্রের মাটির নিচে কোনো সীমানা নেই। এ কারণে যত দ্রুত সম্ভব, বাংলাদেশ অংশে অনুসন্ধান কাজ শুরু করা প্রয়োজন। তারা বলছেন, মিয়ানমারের এ ব্লকটির একেবারে কাছে বাংলাদেশের ১১ নম্বর ব্লক। ১২ মার্চ এ ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দুটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে উৎপাদন বণ্টন (পিএসসি) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে পেট্রোবাংলা। কোম্পানি দুটি হলো অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সান্তোস সাঙ্গু ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জি। চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি দুটি ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে। চুক্তির মেয়াদকাল আট বছর। চুক্তি অনুযায়ী ১১ নম্বর ব্লকে সান্তোস-ক্রিস এনার্জি প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে ১ হাজার ৬ লাইন কিলোমিটার এলাকায় দ্বিমাত্রিক জরিপ ও ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ত্রিমাত্রিক জরিপ কাজ করবে। পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে একটি কূপও খনন করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারের এডি-৭ ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজ করছে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইউ কোম্পানি। ২০১২ সালে কোম্পানিটি মিয়ানমারের উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আওতায় এ ব্লকটির কাজ পায়। চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি ২০১৪ সালের মধ্যে এ ব্লকের সার্বিক জরিপ সম্পন্ন করার কথা। সে অনুযায়ী গত ১০ মার্চ তারা ত্রিমাত্রিক জরিপ কাজ শেষ করেছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, মিয়ানমার সরকার যত দ্রুত সম্ভব গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজ করছে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশের কার্যক্রম অনেক ধীর গতির। ২০১২ সালের পিএসসি চুক্তির পর দুই বছরের মধ্যে তারা জরিপ কাজ শেষ করেছে। আর পেট্রোবাংলা এজন্য কোম্পানিকে পাঁচ বছর সময় দেয়। তারা বলছেন, দ্রুত গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজ জোরদার করা জরুরি। এজন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আরও সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে।