সহিংসতা, জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল না করলে নির্বাচনে হেরে যেতে হয়। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ক্ষমতাসীন জোটের অবস্থান পরিষ্কার হয়। সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে সহিংসতা ও পেশী শক্তির প্রয়োগ করে জয়ী হলে ব্যাপক সমালোচনার পাশাপাশি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে। দাবি জোরালো হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না তা ইতোমধ্যে তিন ধাপের উপজেলা নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে।
সহিংসতা না করলে গণঅনাস্থার মুখোমুখি হতে হয়। আর সহিংতা করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি জোরালো হয়। এ যেন উভয় সংকটে পড়েছে সরকার।
গত ১৯ ও ২৭ ফেব্র“য়ারি পর পর দুই ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দলগতভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পিছিয়ে পড়েছিলো। ভোটের ফলাফলে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে এগিয়ে ছিলো। আর জামায়াতের ফলাফল ছিলো বলা যায় চমক লাগানোর মতো।
ফলে নির্বাচনে জনগণের মনোভাব পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার এখন রাজনৈতিক সংকটের চাইতে অস্তিত্বের সংকটেই পড়তে যাচ্ছে বেশি মাত্রায়। ভোটাররা সরকারকে গণঅনাস্থা জানাচ্ছেন। আর সেই কারণেই গত ১৫ মার্চ তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে সরকারি দল অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠে। যেকোনো মূল্যে নির্বাচনী ফলাফলে এগিয়ে থাকার প্রবণতা দেখায়। এতে সরকারি দলের পুরো খোলস বেরিয়ে আসে।
বস্তুত, উপজেলা নির্বাচনের আয়োজন করতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে সরকার। নির্বাচন দিয়ে সরকার বিজয় নিজের ঘরে আনতে সব ধরনের চেষ্টার পরও ব্যর্থ হচ্ছে।
সরকার দলীয় বাহিনী নির্বাচনী মাঠে প্রতিপক্ষের প্রার্থী ও সমর্থকদের উপর হামলা ও নির্যাতন করলে বদনাম হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন কেন্দ্র সিল মেরে ও কেন্দ্র দখল করে সরকার সমর্থক ক্যাডাররা আওয়ামী লীগকে চরম বেকায়দায় ফেলেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এমন বক্তব্য দেওয়ার নৈতিক অধিকার এখন প্রায় শেষ।
সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা সাম্প্রতিককালে এমন বক্তব্য দিতে খুব একটা দেখাও যাচ্ছে না। আর ইতোমধ্যে যেসব উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেসব উপজেলার ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়।
অধিকাংশেরই মতে, সরকার যদি কোনো রকম একটু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিত তাহলে বুঝা যেত দেশের মানুষ এ সরকারকে কীভাবে অনাস্থা জানায়। উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থার প্রকৃত চিত্র নয় বলেও মনে করেন তারা।
গত ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। দেশের ৪৭টি ভোট কেন্দ্র একজন ভোটার না যাওয়ার নজির সৃষ্টি হয়। ১৫৩ আসনে নির্বাচনেরই দরকার হয়নি। অব্যাহত সমালোচনা থেকে মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে সরকার তড়িঘড়ি করে উপজেলা নির্বাচনের আয়োজন করে।
সরকার পক্ষ প্রায় নিশ্চিত ছিল, বিএনপি ও এর মিত্ররা জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বয়কট করবে। আর ফাঁকা মাঠে গোল করবে আওয়ামী লীগ ও সরকারের অনুগত রাজনৈতিক দলগুলো। উপজেলা পরিষদ স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও বরাবরই রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়েই প্রার্থীরা এ নির্বাচনে অংশ নেয়।
নির্বাচন প্রস্তুতির শুরুতে আওয়ামী লীগ ও সরকারের অংশীদার বিরোধী দল জাতীয় পার্টি গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মতোই উপজেলা ভাগাভাগির একটি ছক তৈরি করেছিলো।
কিন্তু এরই মধ্যে উপজেলায় দলীয় নেতাদের অংশ নিতে নির্দেশ দেয় বিএনপি ও জামায়াত। আর এতেই সরকারে থাকা দল ও শরিক দলগুলোর হিসাব-নিকাশ অনেকটা পাল্টে যায়। শুরু হয় নয়া সমীকরণ, নয়া পরিকল্পনা। তবে তাতেও কোনো কাজ হয়নি। উপজেলায় যে কাক্সিক্ষত ফলাফল নাও আসতে পারে তা ১৯ ফেব্র“য়ারির ভোটের আগেই অনেকটা ধারণা করতে পেরেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। জোর করে কেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপারে সিল মেরে ভোটের অংক পাল্টানোর চেষ্টাও চালানো হয়েছিল অনেক উপজেলায়। তাতেও কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি। ভোটারদের মধ্যে যারা কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার জন্য যেতে পেরেছেন তারা জেনে বুঝেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
এসব দেখে সরকারি দলে জোর করে ফলাফল পক্ষে নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। ২৭ ফেব্র“য়ারি দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে সরকারি সর্মর্থক ক্যাডাররা নির্বাচনী এলাকাগুলোতে অনেক জায়গায়ই বেশ তা-ব চালিয়েছে। ১১৫টি উপজেলার প্রায় সব ক’টিতেই কোনো না কোনো কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে ১৯ দল সমর্থিত প্রার্থীর কর্মীদের উপর। অনেক ক্ষেত্রেই ভোটারদের ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে সরকার দলীয় ক্যাডাররা ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ফেলেছে। আবার আগে থেকেই ব্যালট পেপারে সিল মারা অবস্থায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এরপর এলো ১৫ মার্চ তৃতীয় ধাপের নির্বাচন। এই ধাপের ফলাফলে আওয়ামী লীগ যে কোনো মূল্যে এগিয়ে থাকার গোপন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিলো। হয়েছেও তাই। কিন্তু, এগিয়ে থাকতে গিয়ে সবকিছু লেজেগোবরে করে ফেলেছে। আগের দুই ধাপে যা কিছু প্রভাব খাটানো হয়েছিলো তাতে অনেক ক্ষেত্রে লাজ-লজ্জা রেখেই করেছিলো। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পুরো চেহারা বেরিয়ে আসে। যেসব উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হেরে যাবার সম্ভাবনা আগে থেকেই দেখা যাচ্ছিলো সেগুলোর দু’চার কেন্দ্র নয় পুরো উপজেলাই দখল করে নিয়েছিলো অস্ত্রধারীরা। শুধুমাত্র যেসব উপজেলায় আওয়ামী লীগের এমনিতেই জয়ের সম্ভাবনা ছিলো সেগুলোতে মোটামুটি কিছুটা ভোট হয়েছে। আর সেই সুযোগে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরা অনেকে জয়ী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তা না হলে, বিশেষ করে দাগনভূঞার মতো অবস্থা হলে এই ধাপের ৮১টি উপজেলার সব ক’টিই সরকারি দলের পকেটে ঢুকতো। অথচ এতো কিছুর পরও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ নেতা ও নির্বাচন কমিশনারদের বক্তব্য এক ও অভিন্ন।
বস্তুত, জাতীয় নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ন্যক্কারজনক সমর্থনে একতরফা নির্বাচন করিয়ে সরকার নিজেদের সফল দাবি করলেও উপজেলায় চালে ভুল করে ফেলেছেন বলা যায় সরকারের নীতিনির্ধারকরা। হঠাৎ করে বিএনপি-জামায়াত এভাবে কৌশল পাল্টে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে এমন ধারণা ছিল না আওয়ামী লীগের কাছে।
আবার বিএনপির মধ্যে যারা আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বা স্পাই-এর মতো তথ্য আদান-প্রদান করেন তারাও এবার আওয়ামী লীগকে ভালো কোনো তথ্য দিতে পারেননি। ফলে নির্বাচনে এসে সরকার গ্যাঁড়াকলে পড়েছে। সবার দৃষ্টি এখন উপজেলায়। সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু করতে চাইলে ফল তুলবে বিএনপি-জামায়াত। আর নিজেদের প্রার্থীদের উপজেলায় বিজয়ী করতে প্রভাব খাটালে সমালোচনার ঝড় তুলবে জনগণ। আর দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষকরাও উপজেলা নির্বাচনকে নিবিড়ভাবে র্পর্যবেক্ষণ করছেন।