যে কারণে পারেনি বিএনপি

0
161
Print Friendly, PDF & Email

গোলাম মাওলা রনি

২০১৪ সালটা যেন একটা অজব-গজব হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির জন্য। সময় যেন কাটতেই চায় না। প্রতিদিন চাতক পাখির মতো তারা চেয়ে থাকে আকাশের দিকে, সূর্য কখন অস্ত যাবে! তারপর শুরু হয় নির্ঘুম রাত। বিছানা থেকে উঠে তারা আবার আকাশের দিকে তাকায়, রাতের আকাশের মিটি মিটি তারা কিংবা একাদশীর চাঁদের দিকে তাকিয়ে তারা মনে মনে কিছু একটা আশঙ্কা করে- শুনতে পায় পেঁচার ডাক কিংবা নিকটবর্তী এলাকায় আতশবাজির শব্দ। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা জাগে- হয়তো কিছু একটা হয়ে গেছে অলৌকিকভাবে। তারপর ঘুমাতে যায় এবং সকালবেলা জেগে দেখে- কই, না তো, কিছুই তো ঘটেনি।

বিএনপির সর্বগ্রাসী হতাশা শুরু হয়েছে মূলত ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের পর থেকেই। অথচ এমনটি যে হবে তা কিন্তু বহু লোকে বহুবার বলেছিল সেই ২০১১ সাল থেকেই। তারপরও কেন দলটি ব্যবস্থা নেয়নি কিংবা নিজেদের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করেনি? তারা যেমন তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে অতীতে ভুল ধারণা পোষণ করেছে, তেমনি বর্তমানেও করছে। ফল যা হওয়ার তা-ই হবে, অর্থাৎ অতীতে তারা যত সফলতার সঙ্গে ব্যর্থ হয়েছে তদ্রূপ আগামী দিনে তার চেয়েও অধিকতর গৌরবগাথা নিয়ে ব্যর্থ হবে, যদি না তারা মহান সক্রেটিসের কথামতো সবার আগে নিজেদের চিনতে না পারে।

ইদানীং আমার মধ্যে এক ধরনের জাতীয় জাতীয় নেতার ভাবসাব চলে এসেছে। গলাচিপা-দশমিনার এমপি না হওয়ার গ্লানিকে আড়াল করার জন্য আমি এখন দেশ-জাতিকে নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং গবেষণা করে আত্দতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করছি। আমি নিজেও অন্যান্য বেকুব লোকের মতো নিজের স্বার্থ, সাধ, আহলাদ এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে, দেশ-জাতির মঙ্গল নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি। এ জন্য আওয়ামী বৃত্তের বাইরে গিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির নিরপেক্ষ কম্পাসটি বিএনপির দিকে তাক করে খোঁজার চেষ্টা করছি, কেন এই বিপর্যয় বা কেন এত ব্যর্থতা।

আমরা প্রথমেই দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কিছু কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা এবং পরবর্তীতে সার্বিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিএনপি যদি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তবে দেখতে পাবে যে ভদ্রমহিলা দৈনিক গড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমান গত প্রায় তিন যুগ ধরে। সাধারণত রাত ১২টার পর বিছানায় যান এবং কোনো কোনো দিন রাত ২টা পর্যন্ত জেগে থাকেন। আবার খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন এবং দিনে সাধারণত ঘুমান না। ফলে তার দৈনিক কর্মঘণ্টা গড়ে ১৮ থেকে ২১ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

এবার দ্বিতীয় পর্যায়ে আসি- এত দীর্ঘ সময়ে তিনি কী করেন? আমি বলব সব কিছু করেন। টিভিতে টকশো, দেশি-বিদেশি সিরিয়াল, সিনেমা, ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা যেমন দেখেন, তেমনি নিজেও খেলেন লুডু থেকে ব্যাডমিন্টন পর্যন্ত। দেশের সব পেপার পত্রিকা পড়ার পাশাপাশি কিছুটা সময় ইন্টারনেট ব্রাউজিং এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বইপত্র পড়েন। তার ব্যক্তিগত ডাইরিতে নিজের শিক্ষণীয় এবং করণীয় বিষয়গুলোর ফুটনোট নেন। মাঝে-মধ্যে বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের ডেকে জটলা পাকান এবং মনের আনন্দে আড্ডা মারতে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। একাকী সময়ে নিজের দলটি নিয়ে যেভাবে চিন্তা করেন তেমনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ, নিষ্ক্রিয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য কর্মপরিকল্পনা অাঁটেন। কিন্তু ভুলক্রমেও এসব বিষয় নিয়ে তিনি কারও সঙ্গে পরামর্শ করেন না। তার যখন যাকে যেভাবে লাগে তাকে তখন সেভাবেই ব্যবহার করেন। তিনি এমন সাবধানে এ কাজগুলো করেন যেন দুজনের কথা তৃতীয় ব্যক্তি না জানতে পারে কিংবা চারজনের কথা যেন পঞ্চম ব্যক্তির কাছে প্রকাশিত না হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অতি গোপনীয়তার সঙ্গে যেসব কাজ করেন তা তার একান্ত সহযোগী কিংবা বিশ্বস্তজনও জানতে পারেন না। কেবল সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণই জানেন যাকে বা যাদেরকে তিনি নিয়োজিত করেন কর্মটি সম্পাদনের জন্য। এভাবে কাজ করতে করতে তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের খুব ভালোভাবে বোঝার সুযোগ পেয়েছেন। কোন নেতাটি কতটুকু চালের ভাত খায়, কতটুকু উপরে উঠে সে কতটুকু লাফ মারবে বা নিচে নামতে নামতে সে কতটা নিচে নামতে পারবে, তা বলতে গেলে শেখ হাসিনার মুখস্থ হয়ে গেছে। দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপি সকালে কই যায়, বিকালে কী করে, সন্ধ্যার পর কোন হোটেল বা গেস্ট হাউসে যায় তা তিনি নিয়মিত মনিটর করেন। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত টেলিফোনের কললিস্ট থেকে তাদের আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু এমনকি এসএমএসগুলোর ফটোকপিও তিনি দেখেন এবং প্রয়োজনে সংরক্ষণ করেন। তিনি দরকার মনে করলে সংশ্লিষ্ট নেতাকে এই বাণী পৌঁছে দেন যে, তোমার সব কর্মকাণ্ড আমার জানা আছে।

ফলে আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে শেখ হাসিনাবিরোধী কোনো কিছু করার চিন্তা করাই অসম্ভব। সবাই জানে তাদের ব্যক্তিগত দুর্বলতার নথিগুলো নিয়ে যদি একটু টানাটানি হয় তাহলে ঘরে-বাইরে বেইজ্জতির সীমা থাকবে না। দলের এ অবস্থায় তিনি নেতৃত্ব, সরকার পরিচালনা, কূটকৌশল বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং দৈনন্দিন সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই-তিন স্তর বা টায়ার সৃষ্টি করে রেখেছেন। কিছু টায়ার কেবল লোক দেখানো, কিছু টায়ার রয়েছে টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা এবং সভা-সমিতিতে ব্যবহার করার জন্য। অন্যদিকে কাজের লোক কাজ করে যাচ্ছে কর্ত্রীর নির্দেশে। ফলে দলটির ভেতরকার বাস্তব অবস্থা হলো- কেউ জানে না কোথা থেকে কী হলো, কীভাবে হলো এবং কখন হলো?

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সব কাজ নিজ হাতে করেন এবং কোনো কাজেরই সাক্ষী রাখেন না। তার যদি দরকার পড়ে তবে তিনি টেকনাফ উপজেলার কোনো এক ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতিকে সরাসরি ফোন করবেন। অন্যদিকে দরকার পড়লে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো একটি থানার ওসিকে সরাসরি ফোন করতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগীয় শহরের সব কিছু তিনি নখদর্পণে রাখার চেষ্টা করেন। এত বড় দল কে এমপি হবে, কে মন্ত্রী হবে কিংবা মহিলা এমপি হবে তা শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ জানে না, জানার চেষ্টাও করে না বা তাকে জিজ্ঞাসা করার স্পর্ধাও রাখে না কেউ। গণতন্ত্রের ভাষায়- তার এসব কর্মকাণ্ডকে যে উপাধিতেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন তিনি কিন্তু সফল হয়েছেন।

প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান প্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং থাকবে বা থাকতে হবে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে যদি কাউকে প্রতিযোগিতা করতে হয় তবে তাকেও ন্যায়-অন্যায় বাদ দিয়ে সেই কাজগুলো করতে হবে। যদি তিনি বেশি করতে পারেন তবে প্রতিপক্ষ পরাজিত হবে কিংবা তার কর্মকৌশলে ভিন্নতা আনতে বাধ্য হবেন। অন্যদিকে তিনি যদি কিছুই করতে না পারেন তবে তার ধ্বংসাবশেষের ওপর প্রতিপক্ষ বিজয়ের প্রাসাদ নির্মাণ করবে। এটাই নিয়ম এবং এভাবেই পৃথিবীতে রাজনীতি চলে আসছে অনাদিকাল থেকে। রাজনীতিতে যখন যুদ্ধাবস্থা তখন সেখানে কোনো নীতি-নৈতিকতা থাকে না। নীতি-নৈতিকতা কেবল শান্তির সময়ে। আর বইপত্রে যেসব ভালো ভালো লেখা রয়েছে তা হয়তো সুখের সময়ে শুনতে ভালো লাগে। যুদ্ধের ময়দানে ওসবের দাম নেই দুই পয়সা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু কায়দা কসরত করে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল কেবল ব্রিটেনই নয়, তাবৎ দুনিয়ার মিত্রশক্তিকে নেতৃত্বদান করে যুদ্ধেও বিজয় ছিনিয়ে আনেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী মি. এটলির কাছে হেরে যান। সারা দুনিয়ায় হৈচৈ পড়ে যায়। লোকজন বলাবলি করতে থাকে ব্রিটিশ জাতি অকৃতজ্ঞ! এ অবস্থায় ব্রিটেনের জনগণের মনোভাবের ওপর একাধিক জরিপ পরিচালনা করা হয়। সবাই একবাক্যে উত্তর করে- চার্চিলের নেতৃত্বের গুণাবলী যুদ্ধকালীন প্রযোজ্য; শান্তির সময়ে নয়। তা ছাড়া বিগত যুদ্ধের সময় তিনি বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে যেসব অমানবিক এবং নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন তা এখন তিনি দেশবাসীর ওপর প্রয়োগ করবেন যদি না তাকে আত্মোপলব্ধি করার জন্য কিছুটা সময় না দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে বাদ দিয়ে এবার দলটি সম্পর্কে কিছু বলি। এই দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অন্তত একশ নেতা রয়েছেন, যারা সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ের অন্তত একজন করে হলেও নেতা-কর্মীকে চিনেন এবং নাম ধরে ডাকতে পারেন। এই একশ নেতার মধ্যে হয়তো দুই-তিনজন সভানেত্রীর নেক নজরে আছেন। বাকিরা হয়তো পদবঞ্চিত-অবহেলিত কিংবা প্রতিপক্ষের চক্রান্তে সামনে আসার সুযোগ পাচ্ছেন না। কিন্তু তারপরও তারা ক্লান্তিহীনভাবে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। বিকাল হলেই তাদের শরীর উসখুস করতে থাকে। তারা ঘর থেকে বের হয়ে আওয়ামী লীগের কোনো একটি অফিসে চলে যাবে এবং অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা মারবে। সেখানে গিয়ে তারা হয়তো নানা রকম গ্রুপিং করবে, অনেকের সমালোচনা করবে কিংবা প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্য ফন্দিফিকির করবে। কিন্তু দল, নৌকা প্রতীক, শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাদের সামনে কেউ একটা টুঁ-শব্দ করে নিরাপদে পার পেয়ে যেতে পারবে না।

এবার আসুন বিএনপির বাস্তব অবস্থা মূল্যায়ন করার জন্য। আমি হলফ করে বলতে পারব- বিএনপিতে হয়তো দুই-তিনজনের বেশি লোক নেই যারা সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের একজন বিএনপি কর্মীকে চিনেন কিংবা নাম ধরে ডাকতে পারেন। পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা দলের অফিসের তুলনায় নিজেদের বাসাবাড়ি, অফিস, ক্লাব বা কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁয় আড্ডা মেলাতে পছন্দ করেন। প্রায়ই দেখা যায়, বিএনপি নেতারা তাদের বাসভবনে দুই-চারটা টিভি ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। দলের সমন্বিত কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকার কারণে কোনো ভুঁইফোড়-সংগঠন কর্তৃক আহূত সেমিনার কিংবা মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে গলা ফাটিয়ে শহীদ জিয়ার আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে আত্দতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করছেন। ফলে, ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।

রাজনীতির একটি বিশেষ উপপাদ্য হচ্ছে- এই অঙ্গনে পচা এবং রদ্দি মালের কোনো জায়গা নেই। আওয়ামী লীগ তার দলের দুর্নীতিবাজ এবং চরিত্রহীন চক্রকে এবার মন্ত্রিপরিষদে স্থান দেয়নি। এমনকি তাদের অনেককে দলীয় পদ-পদবি থেকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। নতুন যারা এসেছেন তারা হয়তো ভুল করবেন কিন্তু পূর্বসূরিদের মতো আজান দিয়ে অপকর্ম করবেন না। অন্যদিকে বিএনপি কিন্তু তার দুর্নীতিবাজ চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। গত সাতটি বছরের নির্মম অভিজ্ঞতা এবং ১/১১ এর কারণ এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে দলটি আজ অবধি কোনো মূল্যায়ন বৈঠকে বসেছে কিনা আমার সন্দেহ। কারণ যাদের কারণে বিএনপির পতন হয়েছিল সেই তারাই তো এখন পর্যন্ত দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন। ফলে যা হওয়ার তাই তো হচ্ছে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে।

দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের কাছে তাদের লুটের মাল আল্লাহ-খোদার চেয়ে বেশি প্রিয়। এসব রক্ষায় তারা নিজের স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না, সেখানে দলীয় স্বার্থ তো নস্যি। এসব লোক সঙ্গত কারণেই প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে তাদের অর্জিত সম্পত্তি রক্ষা এবং উপভোগ করার জন্য। বিএনপির যেসব নেতা জেলে আছেন তারা তাদের জেলবাসকে আরামদায়ক করার জন্য করছেন না এমন কর্ম নেই। আবার যারা জেলের বাইরে আছেন তারা জেল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য করছেন না এমন কর্ম নেই। কাজেই এসব এবং সেসব- অর্থাৎ জেলের ভেতরকার এবং বাইরের দুর্নীতিবাজ নেতাদের দিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু একটা করা যাবে- এ কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে অন্তত জনাপঁচিশেক প্রবীণ এবং নবীন নেতা রয়েছেন, যারা সারা জাতির কাছে পরিচিত মুখ। তারা যদি বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে গিয়ে কোনো রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই জনসভার আয়োজন করে, সেক্ষেত্রে লাখ লাখ না হলেও হাজার হাজার লোকের সমাবেশ হবে। চম্বুকের আকর্ষণে লৌহজাতীয় ধাতু যেভাবে ছুটে আসে, তদ্রূপ সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ওইসব নেতার সভায় উপস্থিত হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী ছাড়াও বিভাগীয় পর্যায়ে অনেকে আছেন যাদের দেশবাসী চেনে। অন্যদিকে মধ্য বয়সের অন্তত ডজন খানেক নেতা দেশবাসীর কাছে পরিচিত। তা ছাড়া পঞ্চাশের নিচে বয়স এমন সব তরুণ যুবকরাও ইতোমধ্যে পুরো জাতির কাছে পরিচিতি লাভ করেছে।

অন্যদিকে বিএনপির প্রায় সব নেতাই হয় ঢাকাকেন্দ্রিক, নয়তো বিভাগীয় বা জেলাওয়ারি প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী। সারা দেশের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে আকর্ষিত করতে পারেন এমন ব্যক্তি বিএনপিতে আছেন মাত্র তিনজন- বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী জোবায়দা রহমান। বিএনপি একটি জনপ্রিয় দল, যারা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না তারা বিএনপিকে ভোট দেয়। অর্থাৎ বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের বিরাট অঙ্ককে বলা হয় পপুলার ভোট। পপুলার ভোটাররা সরাসরি কোনো দল করেন না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পপুলার ভোট নেই বললেই চলে। তাদের প্রায় সব ভোটই দলীয় ভোট।

আওয়ামী লীগ সর্বদা সচেষ্ট থাকে তাদের দলীয় ভোটারকে আকৃষ্ট এবং ঐক্যবদ্ধ করে জয়লাভ করার জন্য। অন্যদিকে বিএনপি এখন পর্যন্ত তার দলীয় ভোট এবং পপুলার ভোটের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তারা হয়তো আশাহত হচ্ছে, নয়তো অতিমাত্রায় আত্দপ্রত্যয়ী হচ্ছে। কোনো নির্বাচনে পপুলার ভোটে জয়লাভ করলে হয়তো ক্ষমতায় যাওয়া যায়; কিন্তু দলের কোনো উপকার হয় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতি হয়ে যায়। বিএনপির ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার স্বল্পকালীন সময়ে দলটিকে যতটুকু গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলেন সময়ের বিবর্তনে তা আজ অনেকাংশে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দলটি যতবার ক্ষমতায় এসেছে ততবার নিত্যনতুন সুবিধাভোগী চাটার দলের উৎপাতে সত্যিকার জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারকেরা দূরে চলে গেছে।

‘৭৫-র পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আওয়ামী লীগের তুলনায় ১৯৯০ সাল পরবর্তী আওয়ামী লীগ অনেক শক্তিশালী এবং তুলনামূলক বেশি পরিপাটি। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি, সচ্ছল কর্মীবাহিনী, দেশ-বিদেশের নানা রকম গোপন ও প্রকাশ্য মিত্রদের সার্বিক সহযোগিতা এবং দেশের অভ্যন্তরের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী এবং পেশাজীবীদের একটি বিরাট অংশ আদা-জল খেয়ে দলটির সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছে যে, সেখান থেকে ফেরার কোনো উপায় নেই অর্থাৎ ‘ডু অর ডাই’। অন্যদিকে বিএনপির মধ্যে এমন কজনকে পাওয়া যাবে যারা দলের জন্য ‘ডু অর ডাই’ স্লোগান দিয়ে এগুতে পারবে? দলটির সর্বোচ্চ নেতারা যদি সময় থাকতে এসব বিষয় নিয়ে ভাবেন এবং প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা গ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রে তারাও ভালো থাকবেন এবং দেশবাসীও ভালো থাকবেন।

আর সেটা না হলে তা-ই হবে যেমনটি অতীতে হয়েছে, অর্থাৎ সরকারি দলের কাছে কেবল একের পর এক ধরা খাওয়া এবং পরাজিত হওয়া।

লেখক : রাজনীতিক।

শেয়ার করুন