পাঁচ বছরের ফাঁদে বিএনপি

0
131
Print Friendly, PDF & Email

দীর্ঘ আট বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর আবারও পাঁচ বছরের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে বিএনপি। শত চেষ্টা সত্ত্বেও ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ঠেকাতে না পেরে কার্যত আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের আশা এখন ছেড়েই দিচ্ছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। রাজপথের আন্দোলনের বিষয়টিও প্রায় অনিশ্চয়তার পথে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও ১৯-দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মাঝেমধ্যে আন্দোলনের কথা উচ্চারণ করলেও নেতাদের মধ্যে তেমন কোনো তোড়জোড় নেই। তারা বরং বেশির ভাগই দিন কাটাচ্ছেন মামলা-হামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে। দলীয় প্রধানের মুখে দল গোছানোর মাধ্যমে উপজেলা নির্বাচনের পর সরকার পতনের সর্বাত্দক আন্দোলনের ঘোষণা এলেও এমন কোনো আলামতই এখনো শুরু হয়নি। এ ঘোষণায় বরং হিতে আরও বিপরীত হয়েছে। রাজনৈতিক মামলায় বিএনপি নেতাদের জামিন কেটে দিয়ে কারাগারে পাঠানোর হিড়িক পড়েছে দেশব্যাপী। বিএনপিকে চাপের মুখে রাখতে সরকারের নেওয়া এ কৌশলের শিকার এখন কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতা-কর্মী। ফলে আন্দোলন ফেলে রীতিমতো দৌড়ের ওপর আছেন এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া নিজেও মামলার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছেন আরও গভীরভাবে। গতকালও দুটি দুর্নীতির মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেছেন আদালত। নির্বাচনের আগে যা-ই বলা হোক না কেন, বিএনপির আন্দোলন ও বর্তমান রাজনৈতিক দৈন্যদশার সুযোগে আর আইনের মারপ্যাঁচে পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণেই এখন বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার। ফলে অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া বিএনপির সামনে আপাতদৃষ্টিতে কোনো পথ খোলা নেই বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় এবং পরে কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে না পারার কারণেই বিএনপিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় পড়তে হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল দেখে বিএনপির অনেক নেতা এখন আফসোস করছেন। তাদের মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোটেও কারচুপি করতে পারত না। কারচুপি করার জন্য যে জনসমর্থন দরকার তা সরকারি দলের ছিল না। মাঠ ছিল বিএনপি-জামায়াতের দখলে। এখন বরং আওয়ামী লীগ চাঙ্গা হচ্ছে। এর পরও উপজেলায় ভালো করছে বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের যে কূটনৈতিক সহায়তার আশা এত দিন বিএনপির পক্ষ থেকে করা হয়েছিল, তাও গুড়েবালি। যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের পক্ষ থেকেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পরবর্তী সরকারকেই সমর্থন জ্ঞাপন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল থেকে সরকারের ওপর নতুন নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন রকমের চাপ সৃষ্টি করা হবে বলে যে আশা করা হয়েছিল তাও এখন ভেস্তে যাচ্ছে। জামায়াতের বাইরে শেষ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামও কোনো কাজে লাগেনি বিএনপির। ফলে দলের নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলী, এমনকি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যরাও চুপচাপ। তারা কে কখন কারান্তরীণ হতে পারেন তা নিয়েই ব্যস্ত। স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এবং একজন ভাইস-চেয়ারম্যান তো বলেই ফেলেছেন, ‘ওরা (বিদেশি কূটনীতিকরা) বেইমানি করেছে।’ ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জেলে যাওয়ার পর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একমাত্র দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের সরকারবিরোধী দু-একটি হুমকি ছাড়া আর কেউ খুব একটা মুখ খুলছেন না। তাও আবার কথা বলার আগে ও পরে তিনবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখে নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ এসে পড়ল কি না! এ প্রসঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বিএনপিকে আন্দোলনে আওয়াজ-সর্বস্ব দল হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, বিএনপিকে দিয়ে কখনো আন্দোলন হবে না। অন্যদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বিএনপি যে কী করতে পারে তা সবারই জানা। আর যা-ই হোক বিএনপিকে দিয়ে কোনো আন্দোলন সম্ভব নয়। এটা আজ প্রমাণিত। কাজেই আর আন্দোলনের নামে রাস্তাঘাটে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি না করে পাঁচ বছর পর আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে দল গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে বেগম খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেন মোহাম্মদ নাসিম। এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য আন্দোলন ও নতুন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘জানি না অদূর-ভবিষ্যতে কী হবে। এই সরকারের পতন কবে হবে, কিংবা আন্দোলনের ভবিষ্যৎই বা কী, এর কোনো কিছুই এখন আর বলা সম্ভব নয়। যা হওয়ার হবে। এখন আর এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তবে এভাবে দমন-নীতি চালিয়ে অতীতে কোনো সরকারই টিকতে পারেনি, আমরা আশা করি এ সরকারের অধ্যায়ও একদিন শেষ হবে। কেয়ামত পর্যন্ত এ সরকার ক্ষমতায় থাকবে না।’ দলের প্রভাবশালী একজন ভাইস চেয়ারম্যান এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আন্দোলন বা নতুন নির্বাচনের বিষয়টি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কখন কোনটি হবে তা দিন-তারিখ নির্ধারণ করে বলা সম্ভব নয়। তবে এ সরকারের পরও আরও সরকার আসবে এবং এ সরকার যত বেশি অত্যাচারী হবে, তার পরিণতিও ততই খারাপ ও নির্মম হবে। আবার দলে এমন নেতার সংখ্যাও নেহাতই কম নয়, যারা আশা করছেন গায়েবি কিংবা প্রাকৃতিকভাবেই হয়তো সরকারের পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং দেশে জনগণের সেই কাঙ্ক্ষিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের যুক্তি হলো- বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কথা কেউ কখনো হলফ করে বলতে পারেন না যে ঠিক একই রকম হবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন অন্য কথা। তার মতে, বর্তমান সরকার ক্ষণস্থায়ী একটি সরকার। এ সরকারকে তিনি তাসের ঘরের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, কখন যে এ সরকার পড়ে যাবে তা বলা যায় না। কারণ এ ধরনের জনবিচ্ছিন্ন সরকার কখনোই বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। এদিকে ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে সারা দেশে বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মামলা-হামলা, গ্রেফতার-নির্যাতন ছাড়াও অপহরণ, গুম, হত্যা ও সন্ত্রাসের অহরহ শিকার হচ্ছেন তারা। ফলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের দৃষ্টি এখন কেন্দ্রের দিকে নিবদ্ধ। কেন্দ্র থেকে আন্দোলনের ঘোষণাসহ সঠিক সিদ্ধান্ত চাইছেন তারা। এবার কঠোর কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনের মাত্রা একেবারে সর্বোচ্চ শিখরে তোলার পর হঠাৎ করেই আবার তা একদম নিচে ফেলে দেওয়ার মতো মরণঘাতী সিদ্ধান্ত যেন কেন্দ্র কিংবা দলীয় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে না নেওয়া হয় সেটিই আশা করছেন তারা। কারণ সরকারের নিপীড়নের মাশুল সবচেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে তৃণমূলকেই। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের প্রতি জীবন বাজি রেখে রাজপথে নামার নির্দেশের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের আত্দগোপনে চলে যাওয়ার মতো স্ববিরোধী নির্দেশ যাতে সাম্প্রতিক আন্দোলন সময়ের মতো আর না আসে সেদিকেও হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তৃণমূল নেতারা। তাদের অনুরোধ, বেগম খালেদা জিয়া যেন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না নিয়ে কতিপয় তল্পিবাহকের পরামর্শে বায়বীয় প্রত্যাশায় আন্দোলনের কঠোর কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করেন। নিকট-অতীতে আন্দোলনে যেসব নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের স্বজনদের কান্না এখনো থামেনি। আর বাস্তবতা হলো, বেগম খালেদা জিয়া বা অন্য কোনো নেতা ঢাকা থেকে এখনো পর্যন্ত সেসব কোনো এলাকায় নিহতের কোনো পরিবারকে ন্যূনতম সান্ত্বনা দিতে পর্যন্ত যাননি। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা।

শেয়ার করুন