শক্তির মহড়া, ভোটারদের আঙুল কাটার হুমকি

0
148
Print Friendly, PDF & Email

উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপের ৯১ উপজেলায় ভোটগ্রহণ আগামী রোববার। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার কারণে এ ধাপের নির্বাচন নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীদের শক্তির মহড়ায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তার কারণে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা এসেছে প্রার্থীর পক্ষ থেকে। নির্বাচন কমিশনে এমন নানা অভিযোগ আসছে। গতকাল এক প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে বলেছেন, ভোট কেন্দ্রে গেলে আঙুল কেটে দেয়া হবে। নির্বাচন কমিশনে এমন অভিযোগের স্তূপ জমলেও গতকাল পর্যন্ত দৃশ্যত কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি কমিশন। এদিকে গতকাল একটি উপজেলায় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বদল করতে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে কমিশনে আবেদন করা হয়। দলের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির সদস্য রিয়াজুল কবীর কাওসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারকের কাছে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ২১ জন প্রিজাইডিং অফিসারকে পরিবর্তন করার তালিকা দিয়ে যান। তালিকা অনুযায়ী প্রিজাইডিং অফিসার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানায় ইসি সূত্র। এদিকে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ফিরোজ আহমেদ (স্বপন) প্রকাশ্য জনসভায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকরা ভোট দিতে গেলে আঙুলে কালির ছাপ দেখে দেখে আঙুল কেটে ফেলা হবে বলে হুমকি দিয়েছেন। তার প্রতিপক্ষ প্রার্থী মোহাম্মদ শহিদুল ইসলামের এজেন্ট, নির্বাচনী কর্মীরা যদি ভোটের দিন লাশ হয়ে ফেরে-এর দায়িত্ব কেউ নেবে না বলেও বক্তব্য দেন ফিরোজ আহমেদ স্বপন। বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে ফিরোজ আহমেদের জনসভায় বক্তব্যের সিডি জমা দিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে তার প্রার্থিতা বাতিলের আবদন করেন সাতক্ষীরার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মোহম্মদ শহিদুল ইসলাম মুকুল। এর পরও কমিশনের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতেই হতে যাচ্ছে চতুর্থ ধাপের উপজেলা নির্বাচন। তবে এ ধাপে গত তিন ধাপের চেয়ে বেশি সহিংসতা হতে পারে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইসিকে জানিয়েছে। এসব বিষয়ে বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা সবসময় চাই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে হোক। এই জন্য যা যা করা দরকার আমরা তা-ই করছি। নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষ থেকে প্রিজাইডিং অফিসার পরিবর্তনের তালিকা দেয়া হয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিধির মধ্যে থেকে ইসি সব কাজ করছে। রিটার্নিং অফিসার যদি চান প্রিজাইডিং অফিসারকে পরিবর্তন করবে তাহলে করবে। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর আঙুল কেটে নেয়ার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, এ বিষয় আমার জানা নেই। এরকম কোন অভিযোগ আমি পাইনি। যদি ঘটনা সত্য হয় অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন এবং নিরাপদে পৌঁছতে পারেন- এ জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য মুখের কথা যথেষ্ট নয়। তাই আমরা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করছি। ২৩শে মার্চ নির্বাচনের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে কমিশন। চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ১২৭৭ জন প্রার্থী। নির্বাচনে সহিংসতা এড়াতে ইতিমধ্যে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে আজ থেকে মাঠে নামছে সেনাবাহিনী। পাশাপাশি র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরাও এসব এলাকায় টহল দেবেন। আজ শুক্রবার মধ্যরাতেই শেষ হচ্ছে মিছিল-মিটিংসহ সব ধরনের প্রচার-প্রচারণা। একই সঙ্গে বন্ধ হচ্ছে সব ধরনের যান্ত্রিক যান চলাচল। ভোট গ্রহণ উপলক্ষে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে ইসি। আদালতের নির্দেশে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ও শেরপুর সদর উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি জানান, নির্বাচনের প্রচার মাইক ভাঙচুর করে কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়াসহ বিভিন্ন হুমকি, ভয়-ভীতি এবং নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেয়ার প্রতিবাদে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে জাসদ সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী শরিফুল কবীর স্বপন বর্তমান সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও তার ছেলের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। গতকাল দুপুর ১২টায় তার নির্বাচনী এলাকা কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর গ্রামের নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় সংবাদ সম্মেলন করে বর্তমান সংসদ সদস্য ও তার ছেলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী নিজে তার মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ফিরোজ আল-মামুনের পক্ষে ভোট চাইতে গিয়ে অন্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন এবং সাধারণ ভোটারদের বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ভোট যেখানেই দেন পাস করবে তার মনোনীত প্রার্থী বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যা নির্বাচনী আচরণ-বিধির চূড়ান্ত লঙ্ঘন বলে মনে করেন তিনি। এছাড়াও এমপিপুত্র কলিংস-এর নেতৃত্বে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাদশা ও মজনুসহ ২০/২৫ জন সশস্ত্র অস্ত্রধারী বুধবার রাতে মরিচা ও ফিলিপনগর এলাকায় প্রবেশ করে নির্বাচনী প্রচারে থাকা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এক ব্যক্তিকে বেধড়ক মারপিট করে এবং তার প্রচার মাইক ভাঙচুর করে।
বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর আচরণ-বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী তসলিম তালুকদার। বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য শহীদুল আলম তালুকদারের বাউফল পৌর সদরের বাসভবনে মঙ্গলবার রাত ৮টায় প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারদলীয় প্রার্থী মো. মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী দলীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রচার- প্রচারণায় স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্য করা, একাধিক মাইক ও গাড়ির ব্যবহারসহ প্রকাশ্যে হাটবাজারে মিছিলের অভিযোগ করেন তিনি। গতকাল বুধবার বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী তসলিম তালুকদার মদনপুর এলাকার চন্দ্রপাড়া চৌরাস্তা বাজারে গণসংযোগকালে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী মজিবুরের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে এতে প্রার্থীসহ ২৫ জনকে আহত করে। তফসিল ঘোষণার পরে মোট ৫ বার এলাকায় এসে সরকারদলীয় জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আসম ফিরোজ মজিবুরের পক্ষে সর্বসাধারণের সঙ্গে সাক্ষাৎ, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে যোগদান ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড উদ্বোধনের নামে ভোট চাওয়ার অভিযোগ তুলে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করলেও তিনি কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বলেও অভিযোগ করেন তসলিম।
মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় ১৯ দলীয় জোট সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী রুহুল আমিন দুলাল (দোয়াত-কলম) গতকাল নির্বাচনী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আশরাফুর রহমান (আনারস) তার নিশ্চিত পরাজয় জেনে মঠবাড়িয়ার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি ও ১৯ দলীয় নেতা কর্মীদের মারধর করাসহ প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করেন। এমনকি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য দিবালোকে সাধারণ ভোটারদের মারধর করছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে এই পর্যন্ত বিএনপি’র প্রায় একশ‘ জন নেতাকর্মীদের মারধর ও নৃশংসভাবে কুপিয়ে জখম করেন। এদের হাত থেকে পার-পাচ্ছে না সাধারণ ভোটারও । গত ৮ই মার্চ উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক আবু বকর সিদ্দিক বাদল আমার নির্বাচনী প্রচারের জন্য উপজেলার সাপলেজা বাজারে গেলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর লেলিয়ে দেয়া ক্যাডার বাহিনী তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে যখম করেন। এছাড়াও সাপলেজা ইউনিয়ন বিএনপি’র সহ-সভাপতি ফরহাদ হোসেন, মৎস্যজীবী দলের ইউনিয়ন আহ্বায়ক কবির আহম্মেদ, ইউপি সদস্য শিপন মিয়া, হলতা গুলিসাখালী ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক শামীম আকন। গত ১৮ই মার্চ রাতে সাপলেজা ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি টিপু মিয়াকে কুপিয়ে জখম করেন এ ছাড়াও ১৯শে মার্চ মঠবাড়িয়া ইউনিয়নের যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক নুরুন্নবীর ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র ভাঙচুর করে ও ঘরের মালামাল লুট এবং তার প্রতিবন্ধী ভাই বোন ও মাকে মারধর করে।
স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে জানান: খুলনার রূপসা উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আলী আকবর শেখ নিজে এবং অনুসারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তার অসহায়ত্বের কথা নির্বাচনের দু’দিন আগে গতকাল দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরেন। আলী আকবর শেখ তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমার কর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আমার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। আমার প্রচারণার মাইক ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে কর্মীদের মারপিট করে জখম করা হয়েছে। মহিলা কর্মীদের নানাভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। যে কারনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করি। দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং আমার সকল নেতা-কর্মীর নিরাপত্তার স্বার্থে রূপসা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদ থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলাম। আমার এ সিদ্ধান্তে অনেকেই কষ্ট পাবেন। যে কারণে জনগণের কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কিছু নেই।

শেয়ার করুন