৩ বছর ব্যবধানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ৩২ হাজার ৫ ৮৪ কোটি টাকা

0
134
Print Friendly, PDF & Email

কামাল উদ্দিন সুমন : দেশের বিনিয়োগ খাত দিন দিন  সংকুচিত হচ্ছে । প্রতি বছরেই কমেছে স্থানীয়, যৌথ আর বিদেশী বিনিয়োগ। ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত  বিনিয়োগ খাতের ব্যবধান ৩২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু গত এক মাসের ব্যবধানে বিনিয়োগ কমেছে ২ হাজার ৩শ ৬৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি একে আজাদ জানান দেশের বিনিয়োগ  পরিস্থিতি খুবই নাজুক। তিনি বলেন, শিল্প কারখানার মালিকরা বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ অনুযায়ী কাক্সিক্ষত সরবরাহ পাচ্ছে না। এতে উপাদন ব্যাহত হচ্ছে  বিনিয়োগও কমছে।

সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয়ার ২ মাস পার হলেও দিন দিন কমেছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারকে কার্যত অভিনন্দন জানালেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তা এগিয়ে আসছে না।

এছাড়া আওয়ামী লীগ শাসনের শেষ বছর গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটসহ বহির্বিশ্বে সরকারের নানা রকম অসঙ্গতির কারণে বিনিয়োগ কমে গেছে। যদিও দেশের বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলনকে দায়ী করে আসছে সরকার। কিন্তু একতরফা নির্বাচনের মাধ্যম্যে সরকার গঠন করার পর প্রায় ৩ মাস পরও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কোন ব্যাখ্যা নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ হলো সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা ।

সূত্র জানায়, গত এক মাসের ব্যবধানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ২ হাজার ৩শ’ ৬৪ কোটি টাকা। বিনিয়োগ বোর্ডের হালনাগাদ প্রতিবেদনে জানা যায়, ফেব্রুয়ারিতে মোট বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ২৭৫৫ কোটি টাকা। যা জানুয়ারিতে ছিল ৫১১৯ কোটি টাকা।

এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে ১১৪ টি শিল্প নিবন্ধন হয়। যা আগের মাসে ছিল ১৬৫টি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে বিদেশী নিবন্ধিত শিল্পের সংখ্যা ৯ টিতে নেমে এসেছে। যা জানুয়ারিতে ছিল ১৬টি। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে বিদেশী নিবন্ধিত শিল্পের সংখ্যা কমেছে ৭টি। এ সময় বিনিয়োগ হয়েছে ১৫১ কোটি টাকা। যা আগের মাস জানুয়ারিতে ৮১৬ কোটি সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে কমেছে ৬৫০ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে মাত্র ৭৩২ জনের। যা আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৫৫৫৮ জন। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে কর্মসংস্থান কমে সাড়ে ৪ হাজারেরও ওপরে।

বিনিয়োগ বোর্ড থেকে পাওয়া হিসাব অনুসারে ২০১১ সালে স্থানীয়ভাবে নিবন্ধিত এক হাজার ৭৩৫টি শিল্প প্রকল্পে প্রস্তাবিত মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫৩ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। এ সময় ২২০টি প্রকল্পে শতভাগ বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ হয়েছে ৩৪ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক হাজার ৯৫৫টি শিল্পে স্থানীয়, যৌথ ও শতভাগ বিনিয়োগ হয়েছে ৮৭ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। ২০১২ সালে এক হাজার ৬৫৫টি শিল্প প্রকল্পের বিপরীতে স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৭৮ কোটি ছয় লাখ টাকার।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৩ সালে দেশে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে ৪২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার। নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্পের সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৯৭টি।

সূত্র জানায়, সরকার একদিকে দেশ বিদেশে ইমেজ সংকটে অপরদিকে বিনিয়োগ খাতকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে জ্বালানিমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন খাতে জটিলতা সৃষ্টি করে চলছে বলে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ।

তারা মনে করছেন,বিদ্যুৎ গ্যাস সংকটে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে  তার ওপর আবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগকারীরা আরো হতাশ হয়ে পড়ছেন। এতে করে শিল্পখাতসহ বিভিন্ন খাতে দেখা দিবে আরো কঠিন পরিস্থিতি। উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাওয়ার লোকসানের আশংকায় অনেকে বিনিয়োগ কমিয়ে দিবে ।

এ প্রসঙ্গে রফতানি বিষয়ক সংগঠন ইএবি’র প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী সাংবাদিকদের জানান, বিদেশী পর্যবেক্ষক গোষ্ঠীর কড়া পর্যবেক্ষণ ও নানা শর্তাবলি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে শুধু চলতি মাস নয়, আগামী ৬ মাসেও বিনিয়োগ পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী হতে পারবে না। পাশাপাশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তো আছেই। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে আরও সক্রিয় হওয়ার কথা বলেন তিনি।

বিনিয়োগের অন্যতম রফতানিমুখী শিল্পখাতকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আওতামুক্ত রাখতে আহ্বান জানিয়ে সালাম মুর্শেদী বলেন, এমনিতেই শিল্প উদ্যোক্তাদের দুর্দশার শেষ নেই। দফায় দফায় জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফ্যাক্টরি, স্থাপনা ভাড়া, উৎস কর, আয়কর, আমদানি শুল্ক, ব্যাংকের সুদ হার বৃদ্ধি, ক্াচামাল আমদানি ও রফতানি, পণ্য পরিবহন খাতে ভাড়া বৃদ্ধি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন অবস্থায় বিদ্যুতের মূল্য না কমালে শিল্পখাতে কঠিন দুর্দশায় পড়বে এবং বিনিয়োগ খাত সংকুচিত হবে

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড.এবি মীর্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম জানান, বিনিয়োগের জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদের স্বস্তি। তা এখনও দেখা যাচ্ছে না। অনিশ্চয়তা আগেও ছিল, তবে এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। উপজেলা নির্বাচনের পর বৃহৎ জোট আন্দোলনের আভাস দিয়েছে এবং আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে দেশ সেদিকেই এগুচ্ছে। ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করার মতো কিছু নেই।

পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফের্য়াস জন ড্যানি লুইসএর সাথে সাক্ষাৎকালে সরাসরি বিনিয়োগ করতে আমেরিকার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে সহায়তার কোন ঘাটতি থাকবে না। বুধবার দুপুরে শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমু জানান দেশের বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে সব অন্তরায় রয়েছে সেগুলো দূর করতে দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান তিনি।

শেয়ার করুন