বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ নয়জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানির তারিখ পেছাতে দফায় দফায় আবেদন করে আসছিলেন তাঁদের আইনজীবীরা। গতকাল বুধবারও দুটি মামলায় সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। আদালত তা নাকচ করে অভিযোগ গঠনের নির্দেশ দেন।
গতকাল আদালতকক্ষে উপস্থিত হয়ে খালেদা জিয়া আদালতের ওপর অনাস্থা জানান। তাঁর আইনজীবীরা জানিয়েছেন, অভিযোগ গঠনসংক্রান্ত আদেশের বিরুদ্ধে তাঁরা হাইকোর্টে আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এ ছাড়া একই আদালতে বিচারাধীন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায়ও খালেদা জিয়াসহ চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দুটি দায়ের করে।
গতকাল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক বাসুদেব রায় এসব আদেশ দেন। একই সঙ্গে দুটি মামলায় আগামী ২১ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেন আদালত।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই প্রথম কোনো মামলায় অভিযোগ গঠন করা হলো।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামিদের মধ্যে খালেদা-তারেক ছাড়াও আছেন সাবেক সাংসদ ও ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও জিয়াউর রহমানের বোনের ছেলে মমিনুর রহমান। মামলায় শুরু থেকে পলাতক আছেন কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান।
এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক এ মামলা করে। ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট এ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
এ মামলার আসামি তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে আছেন। গতকাল তাঁকে এ মামলায় পলাতক দেখানো হয়েছে।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া ছাড়াও অপর তিন আসামি হলেন তাঁর সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও তাঁর একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম এবং সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে জমি কেনা নিয়ে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এ মামলা হয়। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় দুদক এ মামলা করে। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
গতকাল দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তারেক রহমান, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, শরফুদ্দিন আহমেদ ও মমিনুর রহমানকে পলাতক দেখিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হারিছ চৌধুরীকে পলাতক দেখানো হয়। একই সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
আদালতের প্রতি খালেদার অনাস্থা: অভিযোগ গঠনের আদেশ শোনার পর আদালতে উপস্থিত আইনজীবীদের খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি আদালতে উপস্থিত ছিলাম, অভিযোগ গঠনের বিষয়ে কোনো প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়নি, সে বিষয়ে শুনানিও হলো না। আদালত জিজ্ঞাসাও করলেন না আমি দোষী না নির্দোষ?’
খালেদা জিয়া প্রশ্ন রাখেন, তাহলে কীভাবে অভিযোগ গঠন করা হলো? তিনি বলেন, এটা বেআইনি, সরকারের কথায় এ অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এটা ন্যায়বিচার পরিপন্থী উল্লেখ করে তিনি আদালতের প্রতি অনাস্থা জানান।
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়া ও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞাসা করতে চাইলে তাঁর আইনজীবীরা আদালতে হট্টগোল করেন। একপর্যায়ে বিচারক এজলাস থেকে নেমে খাসকামরায় চলে যান। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা খাসকামরায় গিয়ে খালেদা জিয়ার অব্যাহতি চেয়ে এবং আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন।
আদালতে আইনজীবীদের শুনানি: গতকাল মামলা দুটির অভিযোগ গঠনবিষয়ক শুনানির দিন ধার্য ছিল। বেলা একটার দিকে খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হন। আদালতকক্ষে রাখা একটি চেয়ারে তাঁকে বসতে দেওয়া হয়।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী রফিকুল ইসলাম মিয়া আদালতকে বলেন, এ মামলার আইনগত বিষয়ে সময়ের আবেদন করা হয়েছে। মামলাটির বৈধতা নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি আবেদন শুনানির জন্য রয়েছে। তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আইনগতভাবে শুনানির সুযোগ নেই।
অপর আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বর্তমানে উচ্চ আদালতে ছুটি চলছে। তা ছাড়া আপিল বিভাগে মামলার বিষয়টি শুনানির অপেক্ষায় আছে। এ অবস্থায় শুনানি হলে তা হবে আইনের পরিপন্থী।
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন বলেন, এ মামলায় আসামিপক্ষ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ৪১ দফা সময় নিয়েছে। ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল বিচার আদালত আপিল বিভাগের আদেশ দাখিল করতে বলেছিলেন। তখন বলা হয়, আসামিপক্ষ এটা দাখিল করতে ব্যর্থ হলে অভিযোগ গঠন করা হবে। এরপর একইভাবে কয়েকটি আদেশ দেওয়া হলেও আসামিপক্ষ বিষয়টি এড়িয়ে গেছে।
দুদকের ওই আইনজীবী বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও একইভাবে সময় নেওয়া হয়েছে। যেহেতু উচ্চ আদালত কোনো মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেননি, তাই অভিযোগ গঠনের ক্ষেত্রে আইনগত বাধা নেই। পরে বিচারক আসামিপক্ষের সময়ের আবেদন নাকচ করে দুদককে অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি করতে বলেন। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা হট্টগোল করেন। বিচারক অভিযোগ গঠনবিষয়ক আদেশ হওয়ার কথা জানিয়ে এজলাস ত্যাগ করেন।
আইনজীবীদের ছোটাছুটি: আদেশের পর বেলা দুইটার দিকে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মহসীন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মোসলেহ উদ্দিন, সানাউল্লাহ মিয়া ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার বিচারকের খাসকামরায় যান। আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার অব্যাহতি চেয়ে আবেদন জানান। সোয়া দুইটার দিকে আবারও বিচারকের কাছে যান আইনজীবীরা। কিন্তু দুদকের আইনজীবীরা ওই আবেদনের অনুলিপি গ্রহণ করতে অপারগতা জানান। এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিচারকের খাসকামরা থেকে বের হন। এজলাসকক্ষে বসে থাকা খালেদা জিয়াকে আইনজীবীরা জানান, আদালত এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বলেছেন। কোনো আবেদন নিচ্ছেন না। এ আদালতের প্রতি তাঁদের আস্থা নেই।
দ্বিতীয় দফায় আদালত: এ পরিস্থিতিতে আদালতের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। এরপর বিচারক বাসুদেব রায় দ্বিতীয় দফায় তিনটা ২০ মিনিটে এজলাসে ওঠেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান। আইনজীবী মহসীন মিয়া বলেন, আদালত যদি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কোনো দরখাস্ত নেবেন না, তাহলে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি করার সুযোগ দেওয়া হোক। তখন দুদকের আইনজীবীরা বলেন, আদালতে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছে। তখন তাঁরা শুনানি করেননি। তাই নতুন করে শুনানির সুযোগ নেই।
এ সময় আইনজীবীরা বিচারককে উদ্দেশ করে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন। বিচারক এজলাস থেকে নেমে যান। পরে আদালতের পেশকার এজলাসে গিয়ে অভিযোগ গঠন ও পরবর্তী তারিখ আইনজীবীদের জানিয়ে দেন।
আদালতে খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার, গোলাম মোস্তফা খান, বোরহানউদ্দিন, মিয়া খোরশেদ আলম প্রমুখ। দুদকের পক্ষে ছিলেন আবদুল্লাহ আবু, রিজাউর রহমান, মীর আবদুস সালাম, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
অভিযোগ গঠনের প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আজ বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সংগঠনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়।