কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেয়া এবং এই শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন সংক্রান্ত সরকারের সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণের আগেই থেমে গেছে। হেফাজতে ইসলামের প্রবল বিরোধিতার কারণে এমন হয়েছে বলে জানা গেছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উন্নত ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতকরণ এবং পেশাগত কাজে তাদের প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য কওমি শিক্ষা উন্নতকরণের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিশন গঠন করে। এক্ষেত্রে বিতর্ক এড়ানোর জন্য কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের চেয়ারম্যান ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে কমিশনটি গঠন করা হয়।
দেশের প্রায় ২৫ হাজার কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী লাখ লাখ। এসব মাদ্রাসার বেশিরভাগই পরিচালিত হয় ব্যক্তিগত অর্থায়নে। ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত এসব মাদ্রাসার সংখ্যা অধিক হওয়ায় এই মাদ্রাসাগুলো নিয়ে এমন একটি পৃথক খাত তৈরি হয়েছে যেখানে সরকারের কোনো পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও অনুমোদন নেই। ফলে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
সরকারি সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে নিবন্ধিত আলিয়া মাদ্রাসা এবং পৃথক পৃথক বোর্ডের অধীনে তাদের নিজস্ব নিয়মে পরিচালিত কওমি মাদ্রাসা। এর মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা একই সঙ্গে আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হন। আর কওমি মাদ্রাসার দাবি, তারা ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক ইসলামিক বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচি অনুসরণ করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পরিচালিত দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো মূলত আরবি, ফারসি এবং উর্দু ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দেয়। এছাড়া বাধ্যতামূলক হিসেবে সীমিত পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি ও অংক শিক্ষাও দেয়া হয় কওমি মাদ্রাসায়।
কওমি মাদ্রাসা থেকে স্নাতকোত্তীর্ণ ব্যক্তিরা মূলত মসজিদে ইমামতি, মাদ্রাসায় শিক্ষকতা এসবের মধ্যে নিয়োজিত থাকেন। প্রতি বছর কওমি মাদ্রাসা থেকে কতজন স্নাতকোত্তীর্ণ হন এর সঠিক তথ্য সরকারের কাছে নেই।
কওমি মাদ্রাসার উন্নয়নে সরকার গঠিত ১৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিশনটি গত বছর চেয়ারম্যান আল্লামা শফীর নেতৃত্বে একটি খসড়া নীতি প্রণয়ন করে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে ছয়টি পর্যায়ে বিভক্ত করে এর কারিকুলাম ও অর্জিত শিক্ষা মূল্যায়নের জন্য একটি কাঠামো নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে খসড়া নীতিও প্রণয়ন করা হয়।
কমিশনের খসড়া নীতিতে কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর- এই ছয় পর্যায়ে বিভক্ত করে প্রতি পর্যায় শেষে পরীক্ষা গ্রহণ ও পরীক্ষা পাসের সনদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়াও অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, অংক এবং সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার পাঠ্যসূচিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই খসড়া নীতি প্রণয়নের ভিত্তিতে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সুনির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘কাওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি নতুন সংস্থা গঠন করতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয়টি একটি নতুন আইনের প্রস্তাবনাও তৈরি করেছে।
১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিশনের কো-চেয়ারম্যান মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, নতুন এই খসড়া নীতিতে এমন কিছুই নেই যার মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা ক্ষুণ্ন হতে পারে। কারণ প্রস্তাবিত কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচির নির্দেশনা অনুসরণ করেই তৈরি করা হয়েছে।
এই প্রস্তাবনাটি গত বছরের ২৮ অক্টোবর অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখের একদিন আগেই হেফাজতে ইসলামের প্রবল আপত্তি ও হুমকির মুখে মন্ত্রণালয় খসড়া উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে।
অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সংশোধনী যুক্ত করার উদ্দেশ্যে খসড়া নীতিটি স্থগিত করা হয়েছে। সূত্রগুলো আরো জানিয়েছে, সরকার কোনো অবস্থাতেই ইসলামিক দলগুলোর নেতাদের এমন কোনো সুযোগ দিতে চায় না যার ফলে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করতে পারে।
গত ২৭ অক্টোবর হেফাজতে ইসলামের প্রধান ও হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সরকার কওমি মাদ্রাসা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলে দেশে ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরু হয়ে যাবে।
সরকারের নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং সংবিধান পরিবর্তনের প্রতিবাদ করতে ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম নামে সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এরপর শাহবাগে আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে আন্দোলনের ডাক দেয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় হেফাজত। পরবর্তী সময়ে ৬ এপ্রিল রাজধানী অভিমুখে লংমার্চ ও মহাসমাবেশ এবং ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থানকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজত দেশ-বিদেশে পরিচিত পায়।
এদিকে হেফাজতের সমর্থক ও অনুসারীরা মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যে অবস্থান নিয়েছেন তাকে অনেকেই রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করেন। কাওমি মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি বলেন, কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের অধিকাংশ কর্মকর্তাই বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতি দুর্বল। তাই তারা চান না যে এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ আওয়ামী লীগ সরকারের তরফ থেকে নেয়া হোক।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধান খালেদা জিয়া কওমি মাদ্রাসার জন্য ‘দাওরা ডিগ্রি’ নামে একটি নতুন ডিগ্রি ও সনদ ঘোষণা করেন। সে সময় বেশ কিছু ইসলামিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছিল- মানবিক বিভাগে ইসলামিক স্টাডিজ কিংবা আরবি সাহিত্যের মতো যে কোনো বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমানের হবে এই ‘দাওরা ডিগ্রি’। কিন্তু এই ঘোষণাটি যতটা না মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে দেয়া হয়েছিল তার চেয়েও এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছিল আসন্ন সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি। অর্থাৎ নিতান্তই নির্বাচনী কৌশল হিসেবে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ফলে বাস্তবে এই ঘোষণার কোনো ফলাফল আর দৃষ্টিগোচর হয়নি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের কর্মকর্তারা মনে করেন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠিত হলে তা বৈদেশিক অনুদানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে এবং এক্ষেত্রে মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন এই কর্মকর্তারা।
তবে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা না চাইলেও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মাদ্রাসাগুলোর অনেক ছাত্র-শিক্ষকই সরকারিভাবে স্বীকৃতি চান। এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কোনো কোনো সংগঠনও ইতোমধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে।
এ ব্যাপারে মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, কওমি মাদ্রাসাগুলো সরকারিকরণ হলে শুধু যে শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু পেশাজীবনই নিশ্চিত হবে তাই নয়, একই সঙ্গে তারা সামাজিক মর্যাদারও অধিকারী হবেন। এছাড়া কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দরজাও উন্মুক্ত হবে।
তার মাদ্রাসাগুলোর ৯০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থীসহ দেশের অধিকাংশ কওমি আলেমরাও একটি একক ও সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের অধীনে থেকে পড়াশোনা করে হাতে সনদপত্র পেতে চান বলেও জানান তিনি। খসড়া নীতিটি অবিলম্বে আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা আমাদের কওমি শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও মানসিকতার উন্নয়ন করতে না পারি তাহলে তাদের পাশাপাশি আমাদের সমাজও পিছিয়েই থাকবে। আর এমন হলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আরো বেশি করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।’
খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, এর ফলে প্রচলিত ব্যবস্থায় কওমি মাদ্রাসা গঠনে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ কিংবা মাদ্রাসা গঠনে সরকারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করা হবে না। কওমি শিক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সুপারিশও করা হয়েছে প্রণীত নীতিটিতে। এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়টি স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের সনদ প্রদান করবে এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গঠন হওয়া পর্যন্ত পৃথক ওই সংস্থাটি কার্যকর থাকবে বলেও খসড়া নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কমিশনের এই খসড়া প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন রয়েছে। আমরা কাওমি মাদ্রাসাগুলোকে স্বীকৃতি দিতে চাই। কিন্তু আমরা আইনটি তখনই বাস্তবায়ন করবো যখন মাদ্রাসার নেতারা সম্মিলিতভাবে এতে মত দেবেন