দেশজুড়ে একের পর এক সহিংসতা চালানো জামায়াতে ইসলামকে যখন নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে, ঠিক সেই মুর্হুতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে পথ চলতে চাইছে জামায়াত। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে শুরু করেছে জামায়াতের নেতারা।
এছাড়া মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে রেকর্ড গড়ার জন্য ‘স্বাধীনতা বিরোধীদের’ (ইসলামী ব্যাংক) কাছ থেকে তিন কোটি টাকাও অনুদান নিয়েছে সরকার। গত শুক্রবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অনুদানের এই অর্থ তুলে দেয়া হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জামায়াতের পক্ষে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে।
এর আগে গত শনিবার রাতে পাবনার আতাইকুলা ইউনিয়ন শাখা জামায়াতের নায়েবে আমির রাজ্জাক হোসেন রাজার নেতৃত্বে জামায়াতের দুই শতাধিক স্থানীয় নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কুষ্টিয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্সের উপস্থিতিতে তারা যোগ দেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, তাদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী কেউ নেই, তাই তাদের যোগদানে আপত্তি করা হয়নি। তবে আতাইকুলা থানা পুলিশ জানায়, যারা যোগ দিয়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই সংসদ নির্বাচনে হরতাল-অবরোধে নাশকতার মামলা আছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, যোগদানকারী জামায়াতের নেতারা মামলা থেকে বাঁচতেই এই কৌশল অবলম্বন করেছেন।
যুদ্ধাপরাধের মামলায় অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বাড়ি পাবনায়।
গত ৩১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় সদস্য নওশের আলী নির্বাচনী জনসভায় প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি জামায়াত নেতা কুষ্টিয়া মোটর যান শ্রমিকদেরও নেতা। নওশের আলী নাশকতার একাধিক মামলা থেকে বাঁচতে আওয়ামী লীগে আশ্রয় নেন। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি আল্লামা ইলিয়াছ হোসাইন বিন হেলালী পরিবর্তনকে বলেন, “পাবনা হচ্ছে জামায়াতের ঘাঁটি। এই ঘাঁটি থেকেই নিজেরা বাঁচতে আজকে আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশ করছে। একদিন তারা দলের বড় ধরনের ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়েই আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এই জামায়াত কর্মীরা কখনো শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে মেনে নিবে না। এখনই তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো প্রয়োজন। বিগত দিনে জনগণের জানমালের ক্ষয়-ক্ষতিকারি যুদ্ধাপরাধীদের অনুসারি জামায়াত মুলত পুলিশের হাত থেকে বাঁচতেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপিদের আশ্রয়ে থাকতে চাইছে। আজকে যারা তাদের আশ্রয় দিচ্ছে একদিন তারাই আক্ষেপ করবে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের যে নেতারা জামায়াতকে তাদের দলে যোগ দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন, তারা যে ভোটে সুবিধা নিতে এটা করছেন, তা নয়। এর পিছনে আর্থিক লেনদেন থাকতে পারে। তারা অর্থের বিনিময়ে জামায়াত সদস্যদের আওয়ামী লীগে আশ্রয় দিচ্ছেন। এই যোগদানের মাধ্যমে জামায়াত সদস্যরা যে আদর্শগত দিক দিয়ে পরিবর্তিত হননি।
তাদের মতে, জামায়াত এখন নানা দিক দিয়ে চাপের মুখে রয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছেও দলটি প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। তাদের নেতারা যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি। তারা নাশকতাসহ নানা সহিংসতার মামলার আসামি। তাই নিজেদের বাঁচাতে কৌশল হিসেবে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড.শান্তনু মজুমদার বলেন, “জামায়াত সদস্যদের আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার সুযোগ করে দিয়ে, শুধু দল হিসেবে আওয়ামী লীগই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং জাতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তির যে একটি বিভাজন রেখা আছে, তা মুছে দেয়ার প্রবণতা এর মধ্যে লক্ষণীয়।”
এ বিষয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক পরিবর্তনকে বলেন, “কোনো অশুভ শক্তির সাথে আতাত করলে সুফল বয়ে আনবে না। এতে আওয়ামী লীগের ঘরে অশান্তি বাড়বে।”
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লা পরিবর্তনকে বলেন, “আওয়ামী লীগের দরজা সবার জন্যই খোলা আছে। তবে কোনো যুদ্ধাপরাধীর ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।”
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রবীণ সাংসদ ও উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পরিবর্তনকে বলেন, “বিষধর সাপ কখন কাকে ছোবল মারে তা বলা যায় না। তবে এই সাপ বাঁচার জন্য অনেক সময় নিরাপদ আশ্রয়স্থলের সন্ধান করবে এটাই স্বাভাবিক। জামায়াত সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগি সংগঠন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার পরিবর্তনকে বলেন, “সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে কেউ ভালোপথে আসতে চাইলে তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত। নতুন প্রজন্ম যদি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ভুল সংশোধন করে তাতে দোষের কিছু নেই। কথা হলো প্রকৃতপক্ষে তারা সহিংসতার পথ পরিহার করলো কিনা।”