খালেদা জিয়া নিজেই সব কমিটি পুনর্গঠন তদারকি করবেন
মার্চ ফর ডেমোক্রেসি ব্যর্থতার জন্য দায়ীরা চিহ্নিত
গুরুত্বপূর্ণ পদে সুযোগ সন্ধানীদের ঢুকতে দেয়া হবে না
মূল্যায়ন হবে যোগ্য, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের
জাতীয় সংসদের নির্বাচন দাবিতে নতুন করে আন্দোলনে যাওয়ার আগে বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। দলে গতিশীলতা আনতে ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার লক্ষ্যে শিগগির হবে পুনর্গঠন। দলের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনগুলোর বেশিরভাগ কমিটিতে পরিবর্তন আসছে। এরই মধ্যে সাংগঠনিক পুনর্গঠনে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নিজেই সব কমিটি পুনর্গঠন তদারকি করবেন। ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগর কমিটির পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সুযোগ সন্ধানী ও নিষ্ক্রিয়রা যাতে কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে না পারে সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’-কর্মসূচির ব্যর্থ হওয়ার পেছনে যেসব নেতার ভূমিকা ছিল তারাই মূলত প্রথমধাপের শুদ্ধি অভিযানের শিকার হবেন। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকার বিরোধী আন্দোলনে দলের প্রথম ও দ্বিতীয় সারির কোন নেতা কী করেছেন সে আমলনামা এখন খালেদা জিয়ার হাতে।
চেয়ারপারসনের দু’জন বিশ্বস্ত উপদেষ্টা জানালেন, কিছু নেতার ওপর হাইকমান্ড চটে আছেন। তারা অনিবার্যভাবে বাদ পড়বেন। আর যারা আন্দোলনের নামে মিথ্যা বলে তাকে ‘বিভ্রান্ত’ করেছেন তাদেরকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের মতে, ওয়ান ইলেভেনের সময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর দলের একটি বড় অংশ সংস্কারের কথা বলে আলাদা বলয় তৈরি করে। এক সময় খালেদাপন্থী ও সংস্কারপন্থী এ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। দলের সিনিয়র ও মধ্যম সারির হাতেগোনা কয়েকজন নেতা সরাসরি খালেদা জিয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও তার পক্ষে অবস্থান নেন। তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন।
অভিযোগ রয়েছে, দলের জন্য এত ঝুঁকি নেয়ার পরও বিগত কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের বেশিরভাগই ছিলেন অবহেলিত। গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ তাদের দেয়া হয়নি। এমনকি অনেক নেতাকে পদই দেয়া হয়নি। এ পরিস্থিতিতে দলের যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তাদের বেশিরভাগই দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। সূত্রমতে, এইসব ত্যাগী ও অভিমানী নেতাদের এবার মূল্যায়ন করা হবে। ৯০-এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতাদেরও সামনে আনা হবে। ক্যাম্পাসের অতীতের ‘লড়াকু’ নেতাদেরও গুরুত্ব দেয়া হবে।
খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত দুই উপদেষ্টা আরও জানান, দলের স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৩-৪ জন সক্রিয়। বাকিরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলেন। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির মোট সদস্য ৩৮৬ জন। এর মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান ১৫ জন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ৩৬ জন, যুগ্ম মহাসচিব ৭ জন, সম্পাদক-সহসম্পাদকদের প্রায় সবাই আন্দোলনের সময় গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। সরকার জানতো তারা কোথায় আছেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তারা গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিরোধী আন্দোলনের সময় কোন কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে ডেকেও খোঁজ পাননি বেগম জিয়া। ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির জন্য ৯টি টিম করেছিলেন চেয়ারপারসন। এসব টিমের নেতারা তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় জনস্রোত বইয়ে দেবেন। নয়াপল্টন হবে তাহরির স্কয়ার। গণঅভ্যুত্থান হবে। কিন্তু ২৮ ডিসেম্বর থেকে সেসব টিমের কোন নেতার হদিস পাননি বেগম জিয়া। ফোনে এবং নানা মারফতে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে বেগম খালেদা জিয়া পেশাজীবী এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে খোলামেলাভাবে বলেছেন যে, দলের কিছু নেতার কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি ঘোরতর সন্দিহান। কারা দুই দিকেই যোগাযোগ রেখে চলেছেন তাদের তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছেন। তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
দলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া তার বাসবভনে অবরুদ্ধ হলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে দুটি ভিডিও বার্তা পাঠান। এতে দলের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে এর প্রভাব পড়ে বেশি। বিশেষ করে শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে তারেক রহমানের ফাঁস হওয়া কথোপকথনে দলের দুই নেতার ভূমিকায় তার ক্ষোভ এবং সন্দেহ জোরালো হওয়ার বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি বেগম জিয়া বিএনপির ঢাকা মহানগরী কমিটির নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘বর্ণচোরাদের দিয়ে আন্দোলন হবে না। নতুন কমিটিতে তারাই স্থান পাবে যারা আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে রাজপথে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘ওয়ান ইলেভেনের সময় দেখেছি বেইমানদের। আবারো দেখলাম। তাই এখন আর কারো তদবিরে কাজ হবে না। দলকে বিশুদ্ধ দলে পরিণত করতে যা যা করা দরকার করবো।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, এই মুহূর্তে সংগঠন গতিশীল করাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না বিগত সময়ের আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ সাংগঠনিক দুর্বলতা। কিভাবে এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যায় সেভাবেই কাজ শুরু করা হয়েছে। আন্দোলনের জন্য নতুনদের প্রয়োজন রয়েছে। তাদেরকেই কমিটিতে সামনে আনতে চাচ্ছেন চেয়ারপার্সন।
স্থায়ী কমিটির অপর এক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘যার যে রকম কর্ম তিনি সে রকম ফল পাবেন। চেয়ারপারসন ত্যাগীদের গুরুত্ব দেবেন। আন্দোলনে শক্ত হতে যাদের দরকার তাদের সামনে আনবেন তিনি।’
বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘বিগত আন্দোলনে কেউ ত্যাগী নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, আবার কেউ তা পারেননি, তাই কারো পদোন্নতি হবে, কারো হবে না। আবার কেউ কেউ শাস্তির মুখেও পড়তে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘নতুন কমিটিগুলো হবে সামনের আন্দোলন-সংগ্রামকে সফল করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তাই যাদের দিয়ে আন্দোলন হবে না, স্বাভাবিক কারণে তাদের দায়িত্বও দেয়া হবে না।’