ভুয়া নাম-ঠিকানায় ৮শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ

0
119
Print Friendly, PDF & Email

ব্যাংক থেকে কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়ায় গ্রেফতারি পরোয়ানা আসে চট্টগ্রামের হালিশহর আই-ব্লক এলাকার বাসিন্দা গোলাম মাওলার কাছে। ঢাকার মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে পাঠানো এ চিঠিতে তার ঠিকানা লেখা রয়েছে বাসা নং-১১, লেন নং-৮, ব্লক-আই। গোলাম মাওলাকে গ্রেফতার করতে হালিশহর থানা থেকে আসে পুলিশও। ভুয়া নাম-ঠিকানায় ৮শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ

দেখা যায়, ঠিকানা ঠিক থাকলেও এ বাড়ির মালিক নন গোলাম মাওলা নামের কেউ। এ বাড়ির ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করেই ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কোটি টাকা।

শুধু গোলাম মাওলা নন; চট্টগ্রামের ৪৭টি ব্যাংক থেকে এভাবে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে আত্মসাৎ করা হয়েছে প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমন ছলনার আশ্রয় নেওয়ায় এখন বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। অর্থঋণ আদালতে মামলা করেও পাওনা আদায় করা যাচ্ছে না।

জানা গেছে, ৭৭০ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ২৫৫ টাকা উদ্ধার করতে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে ৪৭টি ব্যাংক ৮৯টি মামলা করে। ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান, ৬টি গার্মেন্টস, ৬০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ১২ ব্যক্তির নামে এসব মামলা করা হয়। আদালত এসব ব্যক্তির সম্পত্তি ক্রোক করতে নির্দেশনাও দেন। সম্পত্তি ক্রোক করতে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই অন্যের বাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিজের বলে ব্যাংক থেকে নিয়ে গেছেন কোটি কোটি টাকা। তাই মর্টগেজ থাকা এসব সম্পত্তির বিপরীতে নেওয়া ঋণের টাকা পেতে বেগ পেতে হচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে।

বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক মাসুম কামাল ভঁূইয়া বলেন, ‘কিছু প্রতারক ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা ঋণ নিয়েছেন। যে সম্পত্তি দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে তা অনেকে পরে বিক্রি করে ফেলেছেন। আবার অনেকে অন্যের সম্পত্তি নিজের বলে নিয়ে গেছেন ঋণের টাকা। সুসম্পর্ক থাকায় মর্টগেজের এসব সম্পত্তির খোঁজ-খবরও নেয়নি অনেক ব্যাংক।’

একই প্রসঙ্গে নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তার বলেন, ‘ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লোপাট হয়ে যাওয়ার ব্যাপক অভিযোগ আসছে আমাদের কাছে। আদালত সময় বেঁধে দিয়ে পুলিশকে সম্পত্তি ক্রোক করার নির্দেশনা দিচ্ছেন। পুলিশ গিয়ে দেখছে, যে সম্পত্তি ক্রোক করতে বলা হয়েছে সেটির মালিক অন্য কেউ। তাই এটি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে পুলিশ। তৈরি হচ্ছে আইনি জটিলতাও।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড থেকে মেসার্স টিয়া ফার্নিচারের নামে ১৩ লাখ ১৬ হাজার ৩৯১ টাকা; ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে মেসার্স খ্রিস্টর্ন অ্যাসোসিয়েশন গং দুই কোটি ৩৫ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৬ টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড থেকে মো. ইনামুল হক গং এক কোটি ৮০ লাখ ৪৮ হাজার ২৭৫ টাকা, মেসার্স তানিয়া মেরিন ইন্টারন্যাশনাল গং তিন কোটি ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার ৫০৪ টাকা, মেসার্স লাভলী ট্রেডার্স গং ৭৮ লাখ ১৩ হাজার ৮৯৩ টাকা, আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে নাজমুল হোসেন গং ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৬২৪ টাকা, মো. হাসান আজিম গং চার লাখ ৪২ হাজার ৭৬৯ টাকা, ফরমান আলী ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৭৩১ টাকা, মো. লোকমান গং তিন লাখ দুই হাজার ৪৭২ হাজার টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে ফয়সাল আহাম্মদ তালুকদার ৫ লাখ ৯৪ হাজার ১৪৬ টাকা, এমএসইউ সালেনি মেহেন গং ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৯ টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ইলিয়াছ ব্রাদার্স প্রাইভেট গং ৮৫ কোটি ৫৮ লাখ ৮৬ হাজার ৯৯০ টাকা ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ না করায় তাদের সম্পত্তি জব্দ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন অর্থঋণ আদালত। এ রকম আরও ব্যাংক থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছে না।

চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা পরিচালনা করা সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মকবুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে অনেকে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ নিয়েছেন। আইনে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ডের বিধান থাকায় অনেকে শতকোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরও তা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে তালবাহানা করেন।

অনেকে আবার অন্যের সম্পত্তি নিজের দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এ প্রবণতা বন্ধ করতে হলে আইনে শাস্তি আরও কঠোর করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংককেও ঋণ দেওয়ার আগে দলিলপত্র যাচাই করে নিতে হবে ভালোভাবে।’

শেয়ার করুন