টাকা দিয়ে ঋণ ক্রয়

0
135
Print Friendly, PDF & Email

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা থেকে কোনো প্রস্তাব করা হয়নি। তার পরও সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় চটগ্রামের ইমাম ট্রেডার্সকে একবারের মতো (ওয়ান অব বেসিস) ঋণ মঞ্জুর করে। প্রতিষ্ঠানটির জন্য ১০০ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) ও ৭৫ কোটি টাকার এলটিআর (লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট) সীমা নির্ধাারণ করে।

সরেজমিনে চট্টগ্রামে গিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রধান কার্যালয় এই ঋণসীমা মঞ্জুর করে। এটা ধরে তিন দিন পর শাখা ঋণ সীমা দেয়। আর তার আট দিন পর অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর গ্রাহক আবেদন করলে ওই দিনই ঋণপত্র খোলা হয়। রাষ্ট্র খাতের কোনো ব্যাংক এতটা গতিশীল হতে পারে, তা ভেবেই সন্দেহ হয় সোনালী ব্যাংকের পরিদর্শক দলের।

পরিদর্শক দল মুখোমুখি হয় ইমাম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলীর। তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাখার উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ও সহকারী মহাব্যবস্থাপকের (এজিএম) উপস্থিতিতে মোহাম্মদ আলী বলেন, ২০১০ সালের শেষ দিকে এনসিসিসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণগুলো মেয়াদোত্তীর্ণসহ খেলাপি হয়ে যাচ্ছিল। ঋণগুলো নিয়মিত রাখতে ও বিরূপমানে শ্রেণীকরণ ঠেকাতে সোনালী ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি ৭৫ কোটি টাকার এলটিআর ক্রয় করেছেন মাত্র।

মোহাম্মদ আলী পরিদর্শক দলকে আরও বলেন, সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখাতে খোলা স্থানীয় এলসি (ঋণপত্র) দিয়ে কোনো পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। এলসি ও এলটিআর সীমা পাওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন এমডি হুমায়ুন কবীর সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। এমডি দুবার সরাসরি মোহাম্মদ আলীর চট্টগ্রামের অফিসেও যান।

উল্লেখ্য, হল-মার্কের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় হুমায়ুন কবীর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এজাহারভুক্ত আসামি। তিনি এখন পলাতক অবস্থায় আছেন।

তবে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ এলাকায় অবস্থিত ইমাম ট্রেডার্সের কার্যালয়ে গত ৬ মার্চ মোহাম্মদ আলী এ প্রতিবেদকের সরাসরি প্রশ্নের জবাব দেন এভাবে, ‘আমি কাউকে টাকা দিইনি, আগে কাউকে চিনতামই না।’ তিনি জানান, এমডি ও পরিচালনা পর্ষদের দুজন সদস্য চট্টগ্রাম এলে নতুন অনেক গ্রাহককে দাওয়াত দেওয়া হয়। সেখানে তিনি যান। সেখানেই তাঁদের ব্যাংকে গ্রাহক হতে অনুরোধ জানানো হয়। মোহাম্মদ আলী তাঁর বিভিন্ন শিল্প ও বিনিয়োগের বিস্তর তথ্য দেন প্রথম আলোর কাছে।

আবার যে মনোয়ারা ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে ইমাম গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে ৭৫ কোটি টাকার ঋণসুবিধা নিয়েছে, পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। ২৬৩/১ ইউনুস সওদাগর বিল্ডিং (তৃতীয় তলা), খাতুনগঞ্জের ঠিকানায় এর কোনো অস্তিত্ব নেই।

পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইমাম ট্রেডার্স বা ইমাম গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠানই সোনালী ব্যাংকের গ্রাহক ছিল না। ২৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে যে দায়, তার তুলনায় গ্রাহকের সম্পদের পরিমাণ কম। দায়ের পরিমাণ বলা হয়েছে ৬১৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং সম্পত্তির পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা।

মোহাম্মদ আলী এ প্রতিবেদকের কাছে তার বিভিন্ন সম্পত্তির বর্ণনা দেন। কিন্তু ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, এসব সম্পদ থাকতে পারে, তবে তার ওপর ব্যাংকগুলোর কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি বা এগুলো ব্যাংকের কাছে জামানত হিসেবে দেওয়াও হয়নি।

পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ দেওয়ার সময় ইমাম ট্রেডার্সের একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হালনাগাদ ঋণ তথ্য ব্যুরোর প্রতিবেদন (সিআইবি) না নিয়েই ঋণ দেওয়া হয়।

মোহাম্মদ আলী বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। ২০০১-০২ সালের দিকে বেসরকারি পাঁচ ব্যাংক থেকে ওম প্রকাশ আগারওয়াল নামের এক ব্যবসায়ী কয়েক শ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। প্রথম আলোতে এ-সম্পর্কিত একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ ব্যাংক তৎকালে বিশদ অনুসন্ধান চালায়। এ ঘটনায় পাঁচজন এমডিকেও অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় এই ঋণ কেলেঙ্কারিতে মোহাম্মদ আলীর যোগসূত্র দেখতে পায়। সেই যোগসূত্র ধরে তাঁর কাছে নোটিশও পাঠানো হয়। নোটিশ পাওয়ার পর মোহাম্মদ আলী এনসিসি ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেন।

চট্টগ্রামের যেসব আমদানিকারক ও জাহাজভাঙা শিল্পের কাছে ব্যাংকগুলোর কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে পড়েছে মোহাম্মদ আলীর ইমাম ট্রেডার্স তাদের অন্যতম। মোহাম্মদ আলীর কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা বলে জানা যায়।

শেয়ার করুন