চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এনেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ বছরে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এনবিআরের। এ পর্যায়ে কমিয়ে তা করা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হলো ১১ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নিজস্ব কার্যালয়ে আগামী বাজেট ও রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বৃহস্পতিবার এসব কথা জানান। এনবিআরের সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিন মাস দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে—এ কথা উল্লেখ করে গোলাম হোসেন বলেন, ‘বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেই এনবিআরের এ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।’
এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসাব দিয়ে জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৯ হাজার কোটি টাকা। এটি এই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চার হাজার কোটি টাকা কম।
রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা মাথায় রেখেই চলতি অর্থবছরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান।
গোলাম হোসেন বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এনবিআর।
বৈঠকে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে তার ভিত্তিতেই।
সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে বলে মনে করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান।
আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের দর্শন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন গোলাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘আগামী বাজেটকে গরিববান্ধব করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিত্তবানেরা বেশি কর দেবেন, আর কম বিত্তবানেরা দেবেন কম কর।’ করপোরেট করের হার আগামী বাজেট থেকেই কমানো হবে বলে জানান এনবিআরের চেয়ারম্যান।
ধাপে ধাপে করপোরেট করের হার ব্যক্তি আয়কর হারের পর্যায়ে নামিয়ে আনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এতে কর আদায় বাড়বে।’
প্রসঙ্গত, বর্তমানে মোটা দাগে করপোরেট কর হার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ, আর ব্যক্তি আয়করের হার ২৫ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্যহানিকর অর্থাৎ তামাকজাতীয় পণ্যের ওপর বেশি করারোপের চিন্তার কথাও জানান এনবিআরের চেয়ারম্যান।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনীতিবিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছিল। সরকার আইনের শাসনের কথা বলে, কিন্তু শেখ হাসিনার ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হলেও খালেদা জিয়ারটি হয়নি কেন—এমন এক প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, ‘গত ১৬ মাসে ওনার (খালেদা জিয়া) পক্ষে কোনো আবেদন আসেনি। কোনো হিসাব একবার জব্দ করা হলে তা খুলে দেওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হিসাব খুলে দেওয়া হয়েছে, কারণ তাঁর পক্ষে লিখিত আবেদন ছিল।’
অনেক মন্ত্রী-সাংসদের ব্যাংক হিসাবও তখন জব্দ করা হয়েছিল—এ কথা জানিয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের প্রায় সবার হিসাবই খুলে দেওয়া হয়েছে।
গোলাম হোসেন এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘যাঁরা সরকারি ও বিরোধী দলে রয়েছেন, তাঁদের আন-অফিশিয়ালি বলেছি, যাঁদের হিসাব জব্দ রয়েছে তাঁরা এনবিআরে আবেদন করলেই হিসাব খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। ’
আওয়ামী লীগ সরকারেরই গতবারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহাবুবুর রহমানসহ কয়েকজন সাংসদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ব্যাপারে এনবিআর কিছু করবে কি না জানতে চাইলে এর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আয়কর আইন অনুযায়ী তাঁদের বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’ এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে চাননি এনবিআরের চেয়ারম্যান।
ডেসটিনি গ্রুপের বিষয়ে এনবিআরের করা প্রতিবেদনের অগ্রগতি জানতে চাইলে গোলাম হোসেন বলেন, ‘ডেসটিনির কর ফাইল এখনো সচল আছে। কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। তবে আদায়ের চেষ্টা চলছে।’
বর্তমান সরকারের আমলে পরপর তিন বছর এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করেছিল। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা আর ধরে রাখা যায়নি। মূলত গত বছরের ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল—এই তিন মাসে হরতালসহ সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হয়নি। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন) সাধারণত বেশি রাজস্ব আদায় হয়।
কিন্তু গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শেষ পর্যন্ত এনবিআর এক লাখ আট হাজার ২৪৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা আদায় করে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা।
কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে হরতাল, অবরোধসহ রাজনৈতিক কর্মসূচি আরও সহিংস হয়। এতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। হরতাল-অবরোধে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। সে অনুযায়ী বলা যায়, অর্থবছরের প্রথমার্ধের অনেকটা সময়জুড়ে আতঙ্কে সারা দেশের দোকানপাট বন্ধই ছিল বলা চলে। দেশের সরবরাহব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। এসব কারণে অর্থবছরের শুরু থেকেই লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে এনবিআর।