ভোটের আর ঠিক এক মাস বাকি, অথচ ভারতীয় রাজনীতিতে জোটের চিত্রটা এখনো স্পষ্ট হলো না। আর প্রধানত সে কারণে প্রধান দুই দল কংগ্রেস ও বিজেপি এখনো তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে ভারতের ভোট আবহের মূল সুর যেন ‘আগে ফল বের হোক, তারপর সমর্থন-বিরোধিতার সিদ্ধান্ত’।
কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ), বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) এবং অকংগ্রেসি ও অবিজেপি দলগুলোর জোট তৃতীয় ফ্রন্ট—ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এখন প্রধানত এই তিন শিবিরে বিভক্ত। ১৯৯৬ সাল থেকে ভারতে জোট সরকারের যে ধারাবাহিকতা চলছে, তাতে এর বাইরে কোনো সরকার গঠিত হয়নি, হওয়া সম্ভবও নয়।
এবারের নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত যত জরিপ বা সমীক্ষা হয়েছে, প্রতিটিতে এনডিএ এগিয়ে থাকলেও তারাই যে অনায়াসে ‘জাদুকরি সংখ্যা’ ২৭২ ছুঁয়ে সরকার গঠন করবে, এমন কথা কোনো জরিপেই উঠে আসেনি। ঠিক এ কারণেই জোটের চিত্রটাও স্পষ্ট হতে পারছে না। অন্তত চারটি আঞ্চলিক দল ঠিক করেছে, তারা কোনো সরকারকে সমর্থন বা বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নেবে ভোটের ফল দেখে। দলগুলো তাদের তুরুপের তাস আগলে রেখে মহারণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই চার দলের মধ্যে দুটি পূর্ব ভারতের, বাকি দুটি উত্তর ও দক্ষিণের।
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের এই মুহূর্তের রাজনৈতিক অবস্থান হলো কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ের থেকে সমদূরত্ব রাখা। তৃণমূলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান না কংগ্রেস আবার কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসুক। মুসলিম সমর্থন হারানোর আশঙ্কায় প্রকাশ্যে বিজেপিকে আলিঙ্গন করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে ক্ষমতায় এলে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বিপুল পরিমাণ ঋণের সুদ স্থগিত রাখার যে টোপ দিয়েছে, তা অগ্রাহ্য করাও সহজ নয় মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে। মমতা বলেছেন, তাঁর কাছে এবার সবটাই ‘পোস্ট পেইড, প্রি-পেইড’ নয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন তিনিও দেখছেন! তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে বলতে পারে, ৪০টা আসন জিতে লোকসভায় গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন না?’
পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া রাজ্য ওডিশার এখনকার শাসক দল বিজু জনতা দলের (বিজেডি) রাজনৈতিক অঙ্কটা তৃণমূলের মতোই। তবে এর নেতা নবীন পট্টনায়ক প্রধানমন্ত্রিত্বের সম্ভাব্য দৌড়ে নেই। নবীন পট্টনায়ক ১৯৯৯ সালে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্যের ২১টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৯টিই দখল করে কংগ্রেসের পাকাপাকি বিদায়ের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। ২০০৯ সালে রাজ্যে খ্রিষ্টানবিরোধী দাঙ্গার পর তিনি ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করেন। সেই থেকে একার শক্তিতে কংগ্রেস ও বিজেপিকে হারিয়ে রাজ্যপাট কায়েম রেখেছেন। এবারও রাজ্য দখলের ব্যাপারে নিশ্চিত হলেও তিনি কেন্দ্রে প্রয়োজনে বিজেপিকে সমর্থন দেবেন কি না, তা অনুচ্চারিত রেখেছেন। মনে রাখতে হবে, তাঁর কাছে রাজ্যের স্বার্থই প্রথম ও শেষ কথা।
উত্তর প্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) নেত্রী মায়াবতীর রাজনৈতিক দর্শন কোনো দিনই নীতিভিত্তিক নয়। তাঁর দর্শন জাতভিত্তিক। দলিত সম্প্রদায়ের এই নেত্রী চিরকালই বলেন, দলিত সমাজের স্বার্থের জন্য তাঁরা সব রাজনৈতিক দলকেই ব্যবহারে প্রস্তুত। তবে নিজেদের ব্যবহূত হতে দেবেন না। মায়াবতীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একটাই। মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি (এসপি)। এই দলের সঙ্গে আপস না করাটাই তাঁর একমাত্র আগাম ঘোষণা। বাকি সবই নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল।
চতুর্থ চরিত্র তামিলনাড়ুর আন্না দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাজাগামের (এআইএডিএমকে) নেত্রী জয়ললিতা। নবীন পট্টনায়কের মতো তিনিও কিছুদিন তৃতীয় ফ্রন্টের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। শীর্ষ দুই বাম দলকে চারটি আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে একতরফা সব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দুই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেন। এখন তাদের একটির বেশি আসন ছাড়তে নারাজ তিনি। পাশাপাশি ‘বন্ধু’ নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দ্বিধা করছেন না জয়ললিতা। গোপন করেননি দিল্লি পাড়ি জমানোর ইচ্ছেটাও। তাঁর দলের হয়ে তৃতীয় ফ্রন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা লোকসভার সদস্য থাম্বিদুরাই সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আম্মার (জয়ললিতার) জন্মদিনের কেকের ওপরে সংসদ ভবনের মডেল কিংবা নির্বাচনী ইশতেহারে সংসদের ছবি এটাই বোঝায় যে তিনি দেশ শাসনে আগ্রহী।’ স্বপ্ন সফল হোক না-হোক, জয়ললিতা সব রকমের সম্ভাবনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখছেন। বিজেপি তাঁর কাছেও অচ্ছুৎ নয়।
জোটের দিক থেকে বিজেপি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় থাকলেও সরকার গঠনের ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২-এ পৌঁছাতে গেলে তাদের এখনো অনেক পথ হাঁটতে হবে। সেখানেই প্রয়োজন সমর্থনের। মমতা-নবীন-মায়াবতী-জয়ললিতাদের দিকে বিজেপির দৃষ্টিও তাই লোলুপ। কংগ্রেস ভালো করেই বুঝেছে, টানা তৃতীয়বারের মতো ইউপিএ সরকার গঠন প্রায় অসম্ভব। সবগুলো জরিপ সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। তাই কংগ্রেসের দ্বিতীয় চাওয়া, এনডিএ এলেও তা যেন মোদিহীন হয়। কংগ্রেসের এক মুখপাত্র গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে দলের চেয়ে দেশ বড়। ভোটের পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব সম্ভাবনাই খোলা থাকছে।’
প্রধান দুই দলের জোটের চিত্র সম্পূর্ণ হওয়া কিংবা প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করাও তাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আজ শুক্রবার কংগ্রেসের কিছুসংখ্যক প্রার্থীর নাম ঘোষণার চেষ্টা চলছে। বিজেপি বৈঠক ডেকেছে আগামীকাল শনিবার।