পুলিশ বলছে ছাদ থেকে পড়ে গেছেন। অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তাদেরকে কৌশলে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। চট্টগ্রামে খাদ্য অধিদপ্তরের এক নারী সহকারী পরিদর্শক ও তার স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় সৃষ্টি হয়েছে এমনি রহস্য। গতকাল ভোররাতে নগরীর আকবর শাহ এলাকার পূর্ব ফিরোজ শাহ থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত দম্পতি হলেন সঞ্চিতা শীল চৌধুরী (৩৫) ও রাজীব চৌধুরী (৪২)। সঞ্চিতা চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে খাদ্য অধিদপ্তরে সহকারী পরিদর্শক। তার স্বামী রাজীব সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল ভোর ৬টায় এলাকার লোকজন সঞ্চিতা ও রাজীবের লাশ বাড়ির নিচে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন। এই সময় সেখানে নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদের বেশ কিছু ইটের টুকরোও পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। তারা এসে লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠান। এই সময় নিহতদের মাথায় ও গলায় জখমের চিহ্ন দেখা গেছে। সকাল সাড়ে ১০টায় চমেক হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায় সেখানে চলছে স্বজনদের আহাজারি। পরিবারের অন্য সদস্যরা কিছুতেই এই দু’জনের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। তারা অভিযোগ করে বলেন, মৃত্যুর আগে রাত ১১টা পর্যন্ত রাজীব ও সঞ্চিতার সঙ্গে সবার কথা হয়েছে। ওই বাড়িতে থাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তারা খাবার খেয়েছেন। কিন্তু ভোররাতে ওই দম্পতি ছাদে কেন যাবে কিংবা কিভাবে গেল তার কোন জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। তাদের সবার ধারণা সুপরিকল্পিতভাবেই এই দু’জনকে ছাদে নিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। হত্যার আগে স্ত্রী সঞ্চিতাকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। এই সময় ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটলে রাজীবের মাথায় আঘাত করে দু’জনকেই নিচে ফেলে দেয় সন্ত্রাসীরা বলে আশঙ্কা করছেন নিহত সঞ্চিতার ছোট ভাই তড়িৎ শীল। তিনি বলেন, ‘আমার বোন ও তার স্বামীর কোন শত্রু নেই। কিন্তু কারা এই ঘটানো ঘটালো তা আমরা জানতে চাই। নিশ্চয় কেউ সকালে তাদের জেগে ওঠার কথা জানতেন। হয়তো তারাই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।’ নিহত সঞ্চিতার দুই মেয়ে অক্ষয়া ও অর্পা। গতকাল বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে তারা স্তব্ধ হয়ে যায়। তারা দু’জনেই বাড়িতে ছিল। ঘুমিয়েছিল একসঙ্গে। অক্ষয়া বলে, ‘বাড়ির গৃহপরিচারিকার কান্না শুনে আমাদের ঘুম ভাঙে। এই সময় সে চিৎকার করে বলছিল মায়ের মৃত্যুর খবর। পরে দৌড়ে এসে দেখি মা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথার এক পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছে। অন্যদিকে বাবা শুয়ে আছে কাত হয়ে। তার জ্ঞান নেই। রক্তাক্ত।’ অর্পা বলে, ‘মা-বাবা মাঝে মাঝে ভোর রাতে উঠতো এই কথা সত্যি। তবে ছাদ থেকে মা পড়ে যাবেন আর তার সঙ্গে বাবাও মারা যাবেন-এই ঘটনার কোন কিছু আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।’ তবে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা মিলছে না পরিচারিকা সুপ্তা পালের। গতকাল ঘটনার পরপরই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। এই সময় সে পুলিশের কাছে বলে, ‘সঞ্চিতা চৌধুরী ছাদের ওপর ফুল তুলছিলেন। আর তার স্বামী রাজীব নিচে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ পা ফসকে সঞ্চিতা নিচে পড়ে যান। এই সময় নির্মাণাধীন দেয়ালের ইটের টুকরো স্বামীর মাথায় পড়লে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে তাদের দু’জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।’ তবে তার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। তারা জানান, সুপ্তা পাল বেশ কিছুদিন ধরেই সঞ্চিতা চৌধুরীর সঙ্গে ঝগড়া করে চলছে। ক্ষোভ থেকেই সে এমন কথা বলছে। সরজমিন গতকাল দুপুরে নগরীর আকবর শাহ এলাকার পূর্ব ফিরোজ শাহ’র দুর্ঘটনাস্থলের সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাথর। তাতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। এখানে সঞ্চিতা ও রাজীব ৫ বছর ধরে বসবাস করছেন। বাড়িটি তাদের নিজের। সঞ্চিতা চৌধুরীর মা কল্পনা শীল বলেন, ‘হাসিখুশি মেয়েটার জীবনে এই কি ঘটনা ঘটে গেল! কয়েকদিন ধরে দেখছিলাম সে অস্থির। বাড়ি তৈরি করার পর থেকে তার মধ্যে একটা টেনশন কাজ করতো।’ তবে পুলিশ পুরো ঘটনাটি দেখছে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে। এই ক্ষেত্রে তারা বিবেচনায় নিয়েছে গৃহপরিচারিকার বক্তব্যটি। তারা বলেছেন, নিহতদের মৃত্যুর বিষয়ে খোঁজখবর চলছে। তবে এর পেছনে কোন সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড জড়িত আছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বাড়ির গৃহপরিচারিকা বলেছে, ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। সেই বক্তব্যই তারা আপাতত সঠিক বলে ধরে নিয়ে তদন্ত করবে। পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এসএম তানভির আরাফাত মানবজমিনকে বলেন, ‘নিহতদের সঙ্গে কারও পূর্বশত্রুতা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখছি। তবে ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটু খটকা আছে মহিলার স্বামী মারা যাওয়ার বিষয়টিতে। আশা করছি ৭ দিনের মধ্যে পুরো ঘটনা আপনাদের জানাতে পারবো।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, ঘটনার এক ঘণ্টা পর সকাল ৭টায় তাদেরকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। এই সময় ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান ডাক্তাররা। মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক পঙ্কজ বড়ুয়া মানবজমিনকে বলেন, ‘ওদের দুইজনেরই শরীর থেঁতলে গেছে। মুখের কোন অংশ দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটির ভাই অভিযোগ করেছেন ওর বোনের দুই হাতের রগ কাটা। আর তার স্বামীকে কুপিয়ে আঘাত করা হয়েছে। বিষয়টি ময়না তদন্তের পর পরিষ্কার করে বলা যাবে।’