গত ৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি কেন অংশগ্রহণ করেনি তা একটি রহস্য হিসেবে থেকে যাবে। এই রহস্যের একমাত্র উত্তর রয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার পেছনে যে কারনগুলি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী’র চাপে এবং তারেক রহমানের একগুঁয়েমীর কারনে বিএনপি সম্ভবত: নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি জয়ী হতো, এ বিষয়ে ঘোরতর বিরোধীদেরও সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তৃণমূলসহ দলের অনেক নেতা-কর্মীই নির্বাচনে অংশগ্রহনের পক্ষে থাকা সত্বেও দলীয় প্রধানের অনমনীয়তার কারনে বিএনপি’র আর নির্বাচনে অংশ নেয়া হয়ে ওঠেনি। খালেদা জিয়ার ধারনা ছিল, সহিংস আন্দোলন এবং পশ্চিমাদের চাপের মুখে সরকার একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে পিছিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে মুশকিলটি ছিল আন্দোলনের নিয়ন্ত্রন শুরুতেই চলে গিয়েছিল জামায়াত-শিবির ও উগ্রপন্থীদের হাতে। ফলে এ আন্দোলনে জনসমর্থনের বদলে এক ধরনের জনবিমুখতা তৈরী হয়েছিল। সে কারনে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখী মার্চ ফর ডেমক্রেসি কর্মসূচি জনগনের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি এবং সরকার সর্বশক্তি দিয়ে এই কর্মসূচিকে প্রতিহত করতে সফল হয়েছে। তার অন্যতম কারন হচ্ছে, ঢাকায় বিএনপি নেতৃত্ব যেমন মাঠে ছিলেন না, তেমনি সরকার খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে ফেলেছিল। এবারের আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লেও সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শেষতক আন্দোলনের ইতিবাচক পরিনতি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, ঢাকায় কার্যকর কোন আন্দোলন-প্রতিরোধ গড়ে তেলার ব্যর্থতা এবং জনগনকে সম্পৃক্ত করতে না পারায় সরকার স্ব¯িত্মর মধ্যেই ছিল।
আওয়ামী লীগ দশম সংসদ নির্বাচন এককভাবে অনুষ্ঠান করতে পেরে সবচেয়ে বড় মুশকিল আসান করতে সক্ষম হয়েছে। শেখ হাসিনা নিজেও জানতেন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকলে তাঁর দলের ভরাডুবি ঘটবে। সেজন্যই তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল, যাতে বিএনপি নির্বাচনে না আসতে পারে, আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন একটি একক নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে – যার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে ১৫৩ টি আসনে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোন প্রার্থী ছিল না। এ কারনে এ অভূতপূর্ব নির্বাচনটিকে সাংবিধানিকভাবে বৈধ বলে দাবী করলেও কখনই জনভিত্তি প্রদান করা সম্ভব হবে না। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা কোন রহস্য বা রাখ-ঢাকের ধার-ধারেন নি। এটি বিষ্ময়কর যে, নেতিবাচক রাজনীতি একটি এক-রৈখিক যাত্রায় আপাত স্থিতি পেয়েছে শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বে দশম সংসদ নির্বাচনে। আধুনিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় এই নির্বাচন শুধু বিষ্ময়কর নয়, কিম্ভূতকিমাকারও বটে। ভারতের রাষ্ট্রীয় সমর্থনের ওপর দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সংসদ গঠিত হয়েছে, সেখান থেকে আপাতত: জনগনের ভোট ও রাজনীতিকে একরকম জোর করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
আগামী দিনের রাজনীতিতে এবং ভোটের গতি আনার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে। বাংলাদেশের শাসন ইতিহাসে অতীতে একাধিকবার এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান আমলে নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সরকার গঠন করে। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করে মাত্র দু’বছরের মাথায়, তার বত্যয় ঘটিয়ে একদলীয় বাকশাল সৃষ্টি করে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র বহুল কাক্সিখত গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে। পরিনামে সামরিক শাসনের অন্ধকার যাত্রায় সামিল হয় দেশ। চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাকশাল সৃষ্টির পরে পালা বদলের পর আবার জিয়া এবং এরশাদ তাদের শাসনামলে সংবিধানকে কাঁটা-ছেঁড়া করেছেন যথেচ্ছ।
নির্বাচন ছাড়াই বা যেন-তেন প্রকারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতা ধরে রাখার নজির ইতিপূর্বে স্থাপিত হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনে গঠিত দুর্বল, অগ্রহণযোগ্য এই সরকার রাজনীতি ও ভোটের গতি ফিরিয়ে আনতে কতোটা সফল হবে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় কৌতুহলের বিষয়।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় বার্তা নিয়ে এসেছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত অসংগঠিত ও বিভাজিত আওয়ামী লীগ এই বার্তাটি কতোটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে, সেটি অবশ্য এখনই বোঝা যাবে না। তবে এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বার্তাটি হচ্ছে, সরকার যা ভাবছে জনগনের মনোভাবের সাথে যোজনব্যাপী দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, দলীয় সাংগঠনিক নেতৃত্বের দুর্বলতা এখনও লক্ষ্যণীয়। স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগে রয়েছে সুষ্পষ্ট বিভাজন। এই বিভাজন ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও সুবিধাভিত্তিক, আদর্শকেন্দ্রিক নয়। যদি শেখ হাসিনা ও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বার্তাটি পেয়ে থাকেন, তাহলে দলকে আদর্শিক ও গণমুখী করার একটি নতুন চাপ অন্তত: অনুভব করার সুযোগটি পাবেন। তাহলেই কেবল নির্বাসিত রাজনীতি ও জনগনের ভোট প্রয়োগের অধিকারটি ফিরে আসার নতুন একটি সম্ভাবনা আবার তৈরী হবে।
উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থবির রাজনীতিতে আবার একটি চাঙ্গা ভাব ফিরে আসছে। দশম সংসদ নির্বাচনের পরে ক্ষমতাসীন দলের একাধিপত্যে রাজনীতি ও ভোটের অধিকারটি হারিয়ে যেতে বসেছিল। এই নির্বাচন স্থূল অর্থে হলেও ভোটের হাওয়ায় কিছুটা হলেও গতি এনেছে। এটিই প্রথম দফায় দফায় উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার কি পরীক্ষামূলকভাবে তৃণমূলের অবদমিত রাজনীতিতে মুক্ত বাতাস আনতে চাচ্ছেন? এই নির্বাচন ইতিমধ্যেই কঠিনভাবে দলীয় চেহারা লাভ করেছে। কেন্দ্রীয় রাজনীতি তৃণমূলের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রন করার মাধ্যমে একটি মেসেজ দেবার চেষ্টা করছে যে, দলীয় যেকোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ইচ্ছাই প্রধান হয়ে উঠবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের ভোটপ্রবন রাজনীতিতে এই নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপি কিছুটা হলেও প্রান ফিরে পেয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনের পরে বিএনপি’র হতবুদ্ধিকর অবস্থার পরিবর্তন এর ফলে কতোটা হবে, এটি বলা মুশকিল। তবে, এই ফলাফল সন্দেহ নেই বিএনপিকে সক্রিয় হবার প্রেরণা যোগাবে। এই নির্বাচনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, জনগন এর মধ্য দিয়ে একটি কার্যকর, গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের দিকে মানসিকভাবে ধাবিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যাদের জনসম্পৃক্ততা বেশি তারাও ভোটের রাজনীতির দিকে এগোতে বাধ্য হবে।
কয়েকমাস আগের আতঙ্কিত, শঙ্কিত বাংলাদেশের ভয়ংকর পরিস্থিতি মানুষের স্মৃতিতে এখনও অম্লান। ককটেল, বোমা, পেট্রোল বোমার জোরালো বিষ্ফোরন আর গান পাউডারে ঝলসে যাওয়া মুখগুলি আমাদের বিবেককে কতোটা জাগ্রত করতে পেরেছে – তার কোন প্রমান রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশকে এগিয়ে নেয়ার কথা কেউ বলছেন না। ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়া – এই দুই জিগিরে জনগন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে। এই পরিস্থিতির বড় দায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই বড় দলেরই। নি:সন্দেহে আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ এর দায় এড়াতে পারবেন না। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি বিরাজনীতিকিকরনে তারাও গলা মিলিয়েছেন সরবে। রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের চূড়ান্ত পরীক্ষা অবশ্যই নির্বাচন। এর বিকল্প কখনই সন্ত্রাস-জ্বালাও-পোড়াও-হরতাল-অবরোধ-নিরীহ মানুষ হত্যা হতে পারে না। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন হতে পারে বটে, কিন্তু তাতে করে নির্বাসিত হয়ে পড়ে রাজনীতি এবং ভোটের অধিকার।
উপজেলা নির্বাচনে প্রাপ্ত ফলাফলে বিএনপি নেতৃত্ব, বিশেষত: বেগম খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন যে, ৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দলের অংশগ্রহণ কতোটা অপরিহার্য ছিল। শেখ হাসিনা একটি একক নির্বাচন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসতে পারে সেজন্য সবরকম পথ ও পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। সেই পথ ও পদ্ধতিতে ভ্রমন করতে গিয়ে বেগম জিয়া ও তার দল শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেননি – এক অর্থে প্রতিপক্ষকে ওয়াক ওভার প্রদান করেছেন। এর মধ্য দিয়ে সরকারী হিসেবেই বিএনপি ৭০ শতাংশের বেশি জনগনের ভোটাধিকার ও ইতিবাচক রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠাতে আওয়ামী লীগের সহগামী হয়েছে, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে সে দায় কখনই তারা এড়াতে পারবেন না। আমরা মনে করি না, এই শিক্ষনীয় থেকে আপাতত: রাজনীতিতে কোন ইতিবাচক বা গুনগত পরিবর্তন আসবে। খুব ব্যতিক্রমী কিছু না ঘটলে কর্ত¡ত্ববাদী শাসন এবং কট্টর বিরোধিতাই বাংলাদেশের আগামী ভবিষ্যত। আমাদের বুধবার