আন্তর্জাতিকমানের নিরাপত্তাব্যবস্থার শর্ত প্রতিপালন না করার কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে দেশের জ্বালানি তেলের স্থাপনাগুলো। এসব স্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সময় সতর্কতা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হলেও মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শর্ত না মেনে কাজ করায় গত শুক্রবার সন্ধ্যার সময় চট্টগ্রাম বন্দরে যমুনা অয়েলের ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। নিয়মানুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তৈরি করে এমন কাজ (হট ওয়ার্ক) করার আগে জ্বালানি তেলের এসব স্থাপনার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়।
‘ইন্টারন্যাশনাল শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি—আইএসপিএস’ কোডের আওতায় দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্দর নিরাপত্তা কর্মকর্তার (পিএসও) কাছ থেকে এই অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। অনুমতির জন্য আবেদন করার পর একটি প্রতিনিধিদল পরিদর্শন করে শর্ত সাপেক্ষে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার অনুমতি প্রদান করে।
শুক্রবার সন্ধ্যার সময় যমুনা অয়েলের তেলাধারে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার আগে পিএসও থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। এ কারণে সেখানে আগে থেকেই আগুন নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জামসহ কার্যকর ব্যবস্থাও ছিল না।
এ ধরনের স্পর্শকাতর কাজ করার সময়ে আধুনিক যন্ত্র ও পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল বলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে আইএসপিএস কোডের আওতায় দায়িত্বপ্রাপ্ত পিএসও এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যমুনা অয়েল লিমিটেড শর্ত প্রতিপালন না করার কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। কারণ, অনুমতি নেওয়া হলে আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রেখে কাজ করা বাধ্যতামূলক ছিল।’ জ্বালানি তেলের যেকোনো স্থাপনা শর্ত না মেনে কাজ করলে আশপাশের সব স্থাপনা এবং বন্দরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বন্দর ছাড়া বন্দরসহায়ক সংস্থাগুলোতে শুধু দিনের বেলায় হট ওয়ার্কের অনুমতি দেওয়া হয়। আবার
একসঙ্গে একটির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের অনুমতি দেওয়া হয় না। কাজের সময় দায়িত্বশীল সুপারভাইজারকে উপস্থিত থাকতে হবে। ফায়ার ফাইটারের উপস্থিতিতে কাজ করা বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষের সব নিয়মকানুন মেনে চলাও বাধ্যতামূলক।
সাধারণত জ্বালানি তেলের স্থাপনায় নিয়মিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হলেও অনুমতি নেওয়ার হার খুব কম। আইএসপিএস কোডের আওতায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, এ বছর শুধু সিটি গ্রুপের ভ্যান ওমেরেন ট্যাংক টার্মিনাল বাংলাদেশ লিমিটেড ভোজ্যতেলের পাইপলাইন পুনঃস্থাপনের কাজের অনুমতি নেয়। ভোজ্যতেল দাহ্য পদার্থ না হলেও এই কাজ করার জন্য ছয়টি শর্ত দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। আর তাই অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম থাকলে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এর বেশি দেরি হলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
জানতে চাইলে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলীম উদ্দিন গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএসপিএস কোড অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। যাঁরা দায়িত্বশীল ছিলেন, তাঁদের এ ব্যাপারে ঘাটতি ছিল। যদিও হট ওয়ার্কের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি, তবু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে সামনে এ ব্যাপারে কেউ দায়িত্বে অবহেলা করলে তাঁকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন্দরসহায়ক সংস্থা রয়েছে ১৫টি। এসব সংস্থার মধ্যে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল লিমিটেড, ইস্টার্ন রিফাইনারি, টিএসপি কমপ্লেক্স—এই পাঁচটি স্থাপনা বিভিন্ন ধরনের তরল ও কঠিন বিপজ্জনক পণ্য ওঠানো-নামানো করে।
এ ছাড়া বন্দর-সংশ্লষ্ট এলাকা হিসেবে ১৮টি বেসরকারি ডিপো রয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর আইএসপিএস কোড বাস্তবায়ন হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বন্দরসহায়ক সংস্থা ও বন্দর-সংশ্লিষ্ট এলাকায় (বেসরকারি ডিপোগুলো) এই কোড বাস্তবায়ন হয়।