প্রথম দুই দফায় অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে উল্লেখযোগ্য পদে বিজয়ী হওয়া নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চললেও এ নিয়ে নীরব দেশের প্রধান ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণেই জামায়াত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে বিরত থাকছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে দলের অনেকের মতে, প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে ১৯ দলীয় জোটের সাথে কার্যকর সমঝোতা হলে এবং সরকারের পক্ষ থেকে মামলা মোকদ্দমা ও ধরপাকড়ের মতো বাধাবিপত্তির বিষয়গুলো না থাকলে আরো বেশি আসনে বিজয়ী হওয়া সম্ভব ছিল। এ ছাড়া কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, ভোটদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, প্রশাসনের প্রভাব বিস্তার এবং নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততার মতো বিষয়গুলো মোকাবেলায় জোটের কার্যকর কৌশলের ঘাটতির কারণেও অনেক উপজেলা ১৯ দলীয় জোটের হাতছাড়া হচ্ছে বলে মনে করছেন দলটির অনেকে।
এতদসত্ত্বেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে চায় জামায়াত। বাকি কয়েক ধাপের নির্বাচনগুলোয়ও ভালো ফলাফলের প্রত্যাশা করছে দলটি। আগের দুই ধাপের অভিজ্ঞতার আলোকে এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। তবে প্রথম দফায় সরকারি দলের ফলাফল বিপর্যয়ের পর দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে সরকারের নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ বিশেষ করে সুনির্দিষ্ট এলাকায় কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট প্রদানের ঘটনা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা, তৃণমূল পর্যায়ে নতুন করে নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের মতো ঘটনাগুলো জামায়াতের সামনে নতুন করে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
দুই দফা নির্বাচনের পর জামায়াতের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে উপজেলা নির্বাচনকেন্দ্রিক দলের বর্তমান অবস্থান, মনোভাব এবং প্রস্তুতির বিষয়ে এই ধরনের ধারণা পাওয়া যায়। তবে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে জামায়াত বিরত থাকছে। সব উপজেলায় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরই জামায়াত সামগ্রিকভাবে দলের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে বলে জানিয়েছেন দলটির এক শীর্ষ নেতা।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় দফতরের তথ্য মতে, দুই দফায় অনুষ্ঠিত ২১১টি উপজেলার নির্বাচনে জামায়াত চেয়ারম্যান পদে সর্বমোট ২১টি, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫৮টি ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৯টিতে বিজয়ী হয়েছে। প্রথম দফায় ৯৭টির মধ্যে ১৩টি চেয়ারম্যান পদে, ২৩টি ভাইস চেয়ারম্যান পদে ও ১০টি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয় জামায়াত। দ্বিতীয় ধাপে ১১৫টি উপজেলার মধ্যে ঘোষিত ১১৪টি উপজেলায় জামায়াত চেয়ারম্যান পদে ৮টি, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩৫টি ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৯টিতে বিজয়ী হয়। দুই দফার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি সব ক’টি পদেই অনেক ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে।
প্রথম দফায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ঘোষিত ৯৬টি আসনের মধ্যে জামায়াত ১৩টিতে জয়ী হয়। জামায়াত চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিয়েছিল ৩০টিতে। ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াত পায় ২৩টি। এই পদে জামায়াত প্রার্থী দিয়েছিল ৩৭টি উপজেলায়। এদিকে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে পায় ১০টি। এই পদে জামায়াতের প্রার্থী ছিল ১৫টিতে।
দ্বিতীয় ধাপে জামায়াত ২৭টি চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ৮টি, ৫৩টি ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ৩৫টিতে এবং ১৬টি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ৯টি।
জামায়াতের তথ্য মতে, তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে ২০০৯ সালে ৪৬৭টি উপজেলায় এক দিনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জামায়াত চেয়ারম্যান পদে ৭০টিতে প্রার্থী দিয়ে ২৪টিতে বিজয়ী হয়। ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭১টিতে প্রার্থী দিয়ে ২৭টিতে ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৬টিতে প্রার্থী দিয়ে ১৩টিতে বিজয়ী হয়েছিল। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ১০৫টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিল। জাতীয় পার্টি ১৮টি ও অন্যান্য ৩৬টি ছাড়া বাকি সবগুলোতে জিতেছিল আওয়ামী লীগ।
বর্তমানে দেশে উপজেলা সংখ্যা ৪৮৭টি। এর মধ্যে প্রথম দফায় ৯৭টির দ্বিতীয় দফায় ১১৪টি উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জামায়াতের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দুই দফার নির্বাচনের সাফল্যে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রয়েছে। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও নির্বাচনী সহিংসতাকেন্দ্রিক জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে মিডিয়ায় একতরফা প্রচারে কিছুটা বেকায়দায় ছিল জামায়াত। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে জামায়াতের প্রতি জনসমর্থন আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয় পরিষ্কার হয়েছে এবং মিডিয়ার একতরফা প্রচারণা হিতে বিপরীতই হয়েছে বলে মনে করছেন দলটি সংশ্লিষ্ট অনেকে। এ ছাড়া ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে জামায়াতের আন্দোলনকে ঘিরে সরকারের মারমুখী অবস্থান, মিছিল-সমাবেশে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা, মিছিল সমাবেশে পুলিশের সরাসরি গুলিতে দুই শতাধিক দলীয় নেতাকর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনা, নেতা কর্মীদের আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করার মতো ঘটনাগুলোকে জামায়াতের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। জামায়াতের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর যে প্রচারণা সরকারি মহল থেকে চালানো হচ্ছে সেটিও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না এমনটিও মনে করছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, যেখানে সরকার মিছিল-সমাবেশই করতে দেয়নি, মিছিল- সমাবেশ বের করলেই পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে, সেখানে মিছিল-পিকেটিংকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনাকে ঢালাওভাবে ‘সহিংসতা’ আখ্যায়িত করে প্রচারণা চালানোর বিষয়টি অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। জামায়াতের নেতাকর্মীদের মতে, জামায়াত-শিবিরকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে প্রপাগান্ডা চালিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল চালানো হচ্ছে। এই অপকৌশলও কাজে আসবে না বলেই তাদের বিশ্বাস। জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এক সদস্য এ ব্যাপারে বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রাজপথে মিছিল-সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা আর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘সন্ত্রাসী’ তৎরতা কোনোভাবেই এক করে দেখার সুযোগ নেই। দীর্ঘ এক বছরের বেশি টানা আন্দোলনের কোনো পর্যায়েই শত উসকানি সত্ত্বেও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা একটি আগ্নেয়াস্ত্রও হাতে নিয়েছে এমনটি কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। তিনি বলেন, জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শ পরিষ্কার। জামায়াতের আদর্শিক রাজনীতি এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে দেশের মানুষ সমর্থন করে উপজেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটা আরেকবার প্রমাণিত হচ্ছে।
এদিকে চলমান উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জামায়াত অনেকটাই প্রচারবিমুখ থাকার অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো কিছু বলতে রাজি হচ্ছেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি পেলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির বিষয় মাথায় রেখে তা সেভাবে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছেন নেতাকর্মীরা। তবে নেতাকর্মীদের ধারণা বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে এবং কার্যকর বোঝাপড়ার অভাবে দুই দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ কয়েকটি উপজেলায় ১৯ দলীয় জোট আসন হারিয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্র দখল ও জাল ভোট ঠেকানোর ক্ষেত্রে কৌশলের অভাবে ফেনী, যশোহরসহ কয়েকটি জেলায় আসন হারাতে হয়েছে জোটকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের উপজেলা নির্বাচন মনিটরিং সেলের এক নেতা জানান, আগামী কয়েকটি ধাপের নির্বাচনেও জোটের প্রধান শরিক বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী এবং দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ১৯ দলীয় জোটের মধ্যে কার্যকর বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রার্থী মনোনীত করলে এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেসব অনিয়মের ঘটনা ঘটছে সেগুলো মোকাবেলায় কার্যকর কৌশল অবলম্বন করতে পারলে নির্বাচনে জোটের পক্ষে আরো বেশি উপজেলায় বিজয়ী হওয়া যেত। তিনি বলেন, যতই ধাপ পার হচ্ছে ততই নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিতে সরকারি দল নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ করছে। এই অবস্থায় আগামী কয়েক ধাপের নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় তা নিয়েও জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ে শঙ্কা কাজ করছে।