বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগ নাকচ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাবি্লউ মজিনা। তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে সবারই কথা বলার অধিকার আছে এবং তা যথার্থও। কিন্তু কথাগুলো সব সময় বাস্তবসম্মত হয় না। নিঃসন্দেহে আমি কারো বিষয়ে নাক গলাচ্ছি না।’
অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত মজিনা এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশিরা মাঝে মধ্যে তাদের গুরুত্বের কথা ভুলে যায় অথচ তিনি কখনো ভোলেন না।
গত সোমবার কালের কণ্ঠসহ কয়েকটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মজিনা আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হলেও বাংলাদেশিদের সহযোগিতা করতে এ দেশের সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা জোরদার ও জিএসপি পুনর্বহাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা করতে চান।
মজিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বন্ধুরাষ্ট্রগুলো শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চায়। তবে কৌশল বিবেচনার বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
সাক্ষাৎকার পর্বের শুরুতে রাষ্ট্রদূত মজিনা তাঁর সাম্প্রতিক বরিশাল বিভাগ সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এরপর তিনি প্রশ্নের উত্তর দেন। কালের কণ্ঠের পাঠকদের জন্য ওই সাক্ষাৎকার পর্বটি তুলে ধরা হলো :
মজিনা : আমি বরিশালের কথা বলব। কদিন আগেই আমি সেখানে ছিলাম। জানি না, আপনারা সবাই সেখানে গেছেন কি না। আমি ছয়টি জেলা সফর করেছি। এই দেশের সুন্দর একটি অংশ এটি। খুব সম্পদশালী, সবুজ, বড়, পরিচ্ছন্ন ও বন্ধুভাবাপন্ন এলাকা।
বরিশাল বিভাগের মানুষ নতুন এক বাংলাদেশ গড়ছে, যে দেশের কথা আমরা এখানে বসে বলি। তারা সেটি করে দেখাচ্ছে। আমি ও ইউএসএআইডির নতুন মিশন ডিরেক্টর ইয়ানিনা ইয়ারুজেলেস্কি কুয়াকাটায়, আক্ষরিকভাবে দেশের শেষ প্রান্ত এবং এর বাইরের চর এলাকায় ঘুরেছি। সেখানে আমরা দেখেছি, ওই অঞ্চলের মানুষ কী কঠোর পরিশ্রম করছে।
বাংলাদেশকে আমি আগামীর এশীয় বাঘ বলি। আমি ওই দুই ধারণাতেই বিশ্বাস করি। আমি আরো বিশ্বাস করি, মধ্যম আয়ের বাংলাদেশকে। তবে এগুলো কেবলই কথা। জনগণ যখন একে বাস্তবে পরিণত করবে তখনই তা সত্য হবে।
আমরা বরিশাল বিভাগে ছিলাম পাঁচ দিন। এক দিন আমরা পাঁচটি ফেরি পাড়ি দিয়েছি। আপনারা বিশ্বাসও করবেন না আমরা কোথায় গিয়েছি।
অতুল (যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অতুল কেসাপ) যখন এখানে এসেছিলেন, তখন একটি বার্তা আপনারা শুনেছেন। তিনি বলেছেন, আমেরিকা বাংলাদেশের জনগণের পাশে আছে। আমরা গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পাশে আছি। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা বিসওয়ালের কাছ থেকেও আপনারা এটি শুনেছেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি শুনানিতে তিনি বাংলাদেশের জনগণের পাশে আমেরিকার থাকার কথা বলেছেন।
অনেকে বলেন, এসব কথার মধ্যে অনেক ফাঁক আছে। কিন্তু কোথায়? আমার মা বলেন, অযৌক্তিক কথাবার্তা বলা বেআইনি নয়। আপনারা যা বলতে চান বলতে পারেন। কিন্তু আমেরিকা বাংলাদেশের জনগণের পাশে আছে। আমরা যা করছি, তার জন্য আমি অত্যন্ত গর্বিত।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আরো গভীর, টেকসই, বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমার যা করা সম্ভব তার সবকিছুই আমি করব।
আমি মনে করি, একদিন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে রূপান্তর ঘটবে। এটি সহজ হবে না। বিশেষ করে মালিকদের একটি অংশ থেকে বড় বাধা আসবে। এর পরও ওই রূপান্তর ঘটতে যাচ্ছে। আমি মনে করি, অগি্ননিরাপত্তা, কারখানার কাঠামোগত দৃঢ়তা, স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়া- এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আন্তর্জাতিক মানে পেঁৗছাবে। এখন আমরা বাংলাদেশ সরকার, বিজিএমইএ, কর্মী, শ্রমিক, মালিক ও ক্রেতা- সবার সঙ্গেই জিএসপি পুনর্বহাল কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি। ১৫ এপ্রিল ডেডলাইন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। আরো অগ্রগতি প্রয়োজন। আমার মনে হয়, এখানে অনেক সদিচ্ছা আছে। আমি খুব অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
এটি (জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল) হবে কী হবে না সে বিষয়ে আমি কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছি না। তবে আমি জানি, লোকজন কঠোর পরিশ্রম করছে। আমি চাই, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ সবার পছন্দের ও আকর্ষণীয় ব্র্যান্ড হোক। আমি চাই, বাংলাদেশে ডলার বিনিয়োগ উপচে পড়ুক। বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হোক। আমি বাংলাদেশকে এক নম্বর দেশ হিসেবে ভাবি। আমি এক নম্বর লোক। আমি দুই নম্বরি করি না। বাংলাদেশ যে এক নম্বর সে বিষয়ে আমার খুব বেশি জানার দরকার নেই। আমি অনেক জায়গায় গেছি। যেখানেই যাই- এক নম্বর… এক নম্বর…এক নম্বর।
প্রশ্ন : প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ভারতে সন্ত্রাসবাদের নজির আছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন ঝুঁকি কতটা?
মজিনা : আমি মনে করি, সহিংস চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্রসহ সবার জন্যই হুমকি। এ কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সীমান্ত নিরাপদ রাখতে এ দেশের সক্ষমতা বাড়ানো আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। সহিংস চরমপন্থা মোকাবিলায় আমাদের অত্যন্ত সুদৃঢ় সম্পৃক্ততা আছে। রাজশাহীর সারদায় পুলিশ একাডেমিকে আমরা যেভাবে সহযোগিতা করছি, সে জন্য আমি অত্যন্ত গর্বিত। বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো- লাঠি ব্যবহারের মাধ্যমে নয়, বরং কমিউনিটিভিত্তিক প্রক্রিয়ায় পুলিশি কার্যক্রম পরিচালনা করা। তাদের দর্শন হবে- জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, বরং একসঙ্গে মিলে কাজ করা। বাংলাদেশ এটিই করতে চায়।
আমেরিকা এখনো এটি অর্জন করতে কাজ করছে। ষাটের দশকের আগে এর শুরু। এখন প্রায় ৫০ বছর হতে চলল। এ ধরনের উদ্যোগে সময় প্রয়োজন। আমরা অনেক অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি। আমাদের পুলিশি কার্যক্রম জোরদার হয়েছে।
আমরা বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সঙ্গে কাজ করছি। বঙ্গোপসাগরে দ্রুততম নৌযানগুলো আমরা দিয়েছি। সেগুলো খুব দ্রুত চলে। আমি ভয় পাই। সেগুলোর একটি ডিফেন্ডার অন্যটি ডিফায়েন্ট। ডিফেন্ডার ২৫ ফুট দীর্ঘ, আর ডিফায়েন্ট ৩৮ ফুট। অত্যন্ত দ্রুত ওই নৌযানগুলো বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিরাপদ রাখতে অত্যন্ত কার্যকর।
আমি বলব, এগুলোর ফলে বঙ্গোপসাগরে দস্যুতা, ডাকাতির ঘটনা ৭০ শতাংশ কমেছে। ইনস্যুরেন্সের হার কমেছে ৪০ শতাংশ। চট্টগ্রাম এখন আর বিপজ্জনক বন্দরের তালিকায় নেই।
আমরা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে কাজ করি। নেভি সিল তৈরি করতে আমরা সহযোগিতা করি। তারা নেভি সিল বলে না, বলে সোয়াডস (স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডাইভিং অ্যান্ড স্যালভেজ)। তারা যাতে প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে পারে সে জন্য আমরা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করছি।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরের সবচেয়ে বড় জাহাজটি আমরা দিয়েছি। সেটি ৩৭৮ ফুট দীর্ঘ। চমৎকার একটি জাহাজ। আমার খুবই পছন্দ। আর আমি এ রকম আরেকটি জাহাজ দেওয়ার জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করছি। কারণ আমার মনে হয়, নৌবাহিনীর এ রকম দুটো জাহাজ থাকা উচিত।
স্থলসীমান্ত সুরক্ষার কাজ আরো কার্যকরভাবে করতে আমরা সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে নতুন করে সহযোগিতা করছি। এ দেশে সহিংস চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ, অস্ত্রপাচার, মানবপাচার, মাদকপাচার, মৎস্য চুরির (জলসীমায়) ঝুঁকি রয়েছে। আমার আশা, সাগরে একসময় সম্পদ অনুসন্ধান করা হবে। সেখানে গ্যাস আছে কী নেই আমি জানি না। তবে যদি গ্যাস থাকে তবে আপনাদের তা রক্ষা করতে হবে। তাই বাংলাদেশকে আরো সুরক্ষিত করার জন্য আমরা এ দেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করছি।
প্রশ্ন : সম্প্রতি পররাষ্ট্রসচিব পাঁচ দিনের ফলপ্রসূ যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করেছেন। তিনি পেন্টাগন, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের পাশাপাশি পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বৃহৎ পরিসরে সহযোগিতা ও নিরাপত্তা ইস্যুতে আলোচনা করেছেন। আপনারা আমাদের জলসীমা ও স্থলসীমা সুরক্ষায় সহযোগিতা করছেন। সন্ত্রাস দমন ও নিরাপত্তা ইস্যুতে আপনারা (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) যৌথভাবে কাজ করার নতুন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি?
মজিনা : সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতার বিষয়ে আমরা দুই মাস আগে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি। সেটি দুই দেশের সম্পৃক্ততা আরো জোরদারের কাঠামো হিসেবে কাজ করবে। আর এতে আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে। তাই এখানে তিন পক্ষেরই লাভ।
সীমান্ত সুরক্ষায় বাংলাদেশ তার সক্ষমতা বাড়িয়েছে। সেটি সবার জন্যই ভালো। সন্ত্রাসবিরোধী সমঝোতা স্মারক সহযোগিতার আরেকটি ভিত্তি। আগামী ২২ এপ্রিল আমাদের দুই দেশের নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। এ বছরই আরো পরের দিকে হবে সামরিক সংলাপ।
আমাদের এখন সংলাপের তিনটি কাঠামো আছে- অংশীদারি সংলাপ, নিরাপত্তা সংলাপ ও সামরিক সংলাপ। তিনটি আলাদা বিষয়। তবে সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এখন আমরা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে আরেকটি সংলাপ চালু করতে যাচ্ছি, যা এত দিন ছিল না। আমার মনে হয়, টিকফার কথা সবাই জানে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে টিকফার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেটি অনেক বড় ঘটনা। যদিও টিকফা খুব সাধারণ একটি বিষয়। অনেকে এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। ঠিক আছে। কারণ আমার মনে হয়, কোনো বিষয়ে মানুষ কত শব্দ লেখে সে হিসেবে অর্থ পায়। আমি জানি না।
আমার কাছে টিকফা একটি ফোরাম, যেখানে বছরে অন্তত এক বা একাধিকবার আমেরিকা ও বাংলাদেশ একত্র হবে। আমরা যৌথভাবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাধাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি সেগুলো কাটিয়ে ওঠার পথ বের করব। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য এটি যথার্থ ফোরাম। তাই আমি নিশ্চিত, এপ্রিল মাসে আমেরিকা বাংলাদেশে শ্রম অধিকার, কারখানার নিরাপত্তা ও কাঠামোগত সুদৃঢ়তা নিয়ে কথা বলবে। এগুলো জিএসপির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আমরা হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত স্যানিটারি ও ফাইটো-স্যানিটারির বিষয়ে কথা বলব। আমি মনে করি, বাংলাদেশেরও অনেক ইস্যু থাকবে। এই ফোরাম দুই পক্ষেরই আলোচনার স্থান। আর এভাবেই আমরা সমস্যার সমাধান করি। আমি সেতুবন্ধন রচনা করে সমস্যার সমাধান করি। সমস্যা সমাধানের জন্য আপনাদের আগে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। আর এটিই আমরা করছি।
সহিংসতা, সন্ত্রাস, উন্নয়ন উৎসাহিতকরণ, সমৃদ্ধির মতো সব ইস্যুতে আমরা এসব কাঠামো ব্যবহার করি। সহিংস চরমপন্থার সঙ্গে দারিদ্র্য, দুঃশাসন, সেবা দেওয়ার দুর্বল মান, বেকারত্ব- সব কিছুই জড়িত।
শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যকর ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে আমরা উৎসাহিত করি। সহিংস উগ্রপন্থার সমর্থকদের জন্য প্রতিকূল ভূমিতে পরিণত করতে আমরা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করি।
প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছিল। গত বছর আপনার নয়াদিলি্ল সফর নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিতর্ক থেকে এমন ধারণা এসেছে যে, আপনি ভারতকে বোঝাতে (বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান) দিলি্ল গিয়েছিলেন। কিন্তু আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। এটি কি সত্য? আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব ভাগ হয়ে গেছে? কারণে অনেক দেশ নতুন সরকারকে যেমন অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছে আবার অনেক দেশ পাঠায়নি।
মজিনা : আমি বিশ্বের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলি না। আপনারা যখন জেনেছেন, তখন আপনারাই বিশ্বের সঙ্গে কথা বলুন। আপনাদের বিশাল খরচের হিসাব আছে। আপনারা বিজনেস ক্লাস টিকিট কিনতে পারেন।
তবে আমি আমেরিকার কথা বলি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আছে। ৬ জানুয়ারি আমরা তা বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছি। আপনারাও তা ভালোভাবে জানেন।
আমরা সেই অবস্থানেই আছি। ১১ ফেব্রুয়ারি নিশা বিসওয়ালের জবানবন্দিতে ও নিশার সহকারী হিসেবে অতুলের সফরে (বাংলাদেশে) আমরা সেই দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই গুরুত্বারোপ করেছি।
আমি যখন ভারতের অবস্থান বিবেচনা করি তখন আমি প্রথমে বলব, ভারত অবশ্যই তার নিজের কথা বলতে পারে। তারা তাদের অবস্থান সরাসরি আপনাদের জানাতে পারে।
আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলো- আমেরিকা, ভারত ও বাংলাদেশের অন্য অনেক বন্ধু এ দেশ নিয়ে একই প্রত্যাশা লালন করে। শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও সমৃৃদ্ধ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবার জন্যই ভালো। নিঃসন্দেহে তা ভালো আমেরিকা ও বাংলাদেশের জনগণের জন্যও। তাই আমি মনে করি, প্রত্যেকেই এটি চায়। আর নিঃসন্দেহে দিলি্লতে অবস্থানের সময় আমি ওই বার্তাই পেয়েছি। বাংলাদেশ ইস্যুতে সবার মনোভাবের মূল বিষয় হলো কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর সমন্বয়। এখন প্রক্রিয়া বিবেচনার বিষয়ে লোকজনের মধ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে। হতে পারে, নাও হতে পারে। আমি জানি না।
ভারত নিজেই বলতে পারে। তাদের সঙ্গে কথা বলুন। তবে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। আর আমরা এটি বলে আসছি।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রদূত মজিনা, আপনি যেমনটি বলেছেন যে, ৬ জানুয়ারি থেকে ডেপুটি অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অতুলের সফর, আজ পর্যন্ত আপনাদের অবস্থান অভিন্ন। তবে ১১ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে আপনি সাক্ষাৎ করেছেন এবং এরপর আপনি আমাদের (সাংবাদিকদের) বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চায় এবং একই সঙ্গে সম্পর্ক (দুই দেশের সরকারের মধ্যে) স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। তাই অনেকে ভাবছেন আপনারা শান্তিপূর্ণ, উন্নত ও নিরাপদ গণতান্ত্রিক দেশের জন্য জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখলেও বিষয়টি নিয়ে এখানে আগের মতো উষ্ণতা নেই।
মজিনা : সেগুলো আপনাদের কথা, আমার নয়। ১১ ফেব্রুয়ারি নিশা বিসওয়াল নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাই এটি (ত্রুটিপূর্ণ) নিজেই অর্থবহ। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে- এটিই আমাদের অবস্থান। নিশা যে কথা বলেছেন, অতুল যা বলেছেন আর আমি অব্যাহতভাবে যা বলে যাচ্ছি তা অভিন্ন। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে আমাদের অংশীদার হওয়ার অঙ্গীকার বদলায়নি। মৃত্যুহার কমাতে আমরা গর্ভবতী নারীদের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখব। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের সঙ্গে আমরা কাজ করি, যাতে তাদের মৃত্যুহার কমে। বরিশাল, খুলনা ও অন্যান্য স্থানের কৃষকদের সঙ্গে আমরা কাজ করি, যাতে তারা আরো বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারে। আমরা তাদের পরিবারগুলোর সঙ্গে কাজ করি, যাতে তাদের খাবার কেনার সামর্থ্য থাকে। আমাদের মায়েদের সঙ্গে কাজ করি, যাতে তারা তাদের সন্তানদের অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার উপায় জানতে পারে। ৪১ শতাংশ বাংলাদেশি ঠিকমতো বেড়ে ওঠে না। এটা ইতিহাস। এটি কেন ৪১ শতাংশ হবে? সম্পদশালী এই দেশে কেন এই হার শূন্যতে নামবে না? এসব খাতে আমরা কাজ অব্যাহত রাখব।
প্রশ্ন : আপনি বাংলাদেশের জনগণকে সহযোগিতার কথা বলছেন। এর অর্থ কি আপনারা সরকারের কাছ থেকে কিছুটা হলেও দূরত্ব রাখতে চান?
মজিনা : আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করি। আপনারা যখন কাজ করেন তখন বাংলাদেশের জনগণকে সহযোগিতা ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার জন্য সরকারের সঙ্গে অংশীদারের মতো কাজ করতে হয়। আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করি। মতিয়া চৌধুরী- আমার দৃষ্টিতে চমৎকার একজন মন্ত্রী। কৃষি উন্নয়ন বিষয়ে আমরা তাঁর সঙ্গে কাজ করি। আমরা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আছি। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, বাংলাদেশের জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণকে আপনাদের সহযোগিতা দিতে হবে।
আমার অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। সবাই এ নিয়ে কথা বলি। এশিয়ার বাঘ হতে আমি সহযোগিতা করতে চাই। আমি এটি আন্তরিকভাবেই বলি। কেন নয়? আমি মনে করি না, সহযোগিতা না করার মতো কোনো কারণ আছে।
প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঢাকায় আনা এবং টিকফা স্বাক্ষর করা আপনার স্বপ্ন ছিল। দুটিই পূরণ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে ঢাকায় আনার মতো কোনো স্বপ্ন কি আপনার আছে?
মজিনা : হ্যাঁ, আমার অনেক স্বপ্ন আছে। সম্ভবত আমার স্বপ্ন আমার মধ্যে রাখাই ভালো। আমি ছোট চিন্তা করি না। আমি বিশাল চিন্তা করি। আমি অংশীদারিত্বের কথা ভাবি। আমি মনে করি, আমেরিকা ও বাংলাদেশ স্বভাবগত বন্ধু। এই অঞ্চলসহ প্রত্যেকের স্বার্থে আমি অংশীদারিত্বকে গভীর, বিস্তৃত ও জোরালো করতে চাই। শেষ পাঁচ মিনিটেও আমার এই লক্ষ্য থাকবে।
প্রশ্ন : আসল না নকল জানি না। সম্প্রতি আল-কায়েদা প্রধান এক ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশিদের জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন।
মজিনা : আমি ওই ভিডিওর বিষয়ে অবগত। সেটি (আল-কায়েদার বার্তা) আসল কি না তা জনগণ পর্যালোচনা করছে। আমি এ বিষয়ে জানি না। তবে আমি জানি, এতে মোটেও বাংলাদেশের প্রতিফলন ঘটেনি। যে ওই কথা বলছে, আমি মনে করি, সে এদেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না। কারণ বাংলাদেশ তেমন নয়। এটি সুন্দর দেশ। এ দেশের মানুষ ভালো। তারা উদার, সহনশীল। তারা গণতন্ত্র ভালোবাসে, সোনার বাংলা গড়তে চায়।
ওই ভিডিও আসল না নকল জানি না। তবে ওই ভিডিওতে সোনার বাংলার কথা বলা হয়নি। সেখানে সব ধরনের ধ্বংসাত্মক বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ এমন নয়। বাংলাদেশে আমার ছয় বছর হলো। অনেক স্থান ঘুরেছি আমি। ভিডিওর বাংলাদেশের মতো কিছু কখনোই দেখিনি।
সহিংসতা, ধ্বংসযজ্ঞ, ভিন্নমত পোষণকারীদের ওপর করারোপ করার মতো চিন্তা আমি প্রত্যাখ্যান করি। বাংলাদেশ খুবই সহনশীল ও সুন্দর দেশ।
প্রশ্ন : পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার প্রতিবেদনে আপনারা বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি আপনারা এক র্যাব কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে সক্ষমতা বৃদ্ধিবিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে নেননি। আপনি কি আপনাদের অবস্থান সম্পর্কে বলবেন?
মজিনা : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার প্রতিবেদন সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিবেদন। এতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। বিশ্বের সব দেশের বিষয়েই আমরা এমন প্রতিবেদন তৈরি করি।
ওই প্রতিবেদনের প্রতিটি বিষয়ের বাস্তব ভিত্তি আছে। আমরা বিশ্বাস করি, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা সরকারের কাজ। জোরপূর্বক নিরুদ্দেশ বা যেকোনো ধরনের গুমের সংখ্যা শূন্য হওয়া উচিত।
প্রশ্ন : মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদনে আপনারা সরকারের অঙ্গীকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। আপনারা বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সরকারের কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়া (জিরো টলারেন্স) উচিত।
মজিনা : সরকারের পক্ষ থেকেই এমন বক্তব্য এসেছিল। সরকারের কাছেই আপনারা ওই প্রশ্ন করুন। অন্য লোক কী বলল সে বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গ্রেপ্তারের জন্য যারা দায়ী তাদের দায় নিরূপণ করতে প্রতিবেদনে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই ঘটনাগুলো তো এমনি এমনিই ঘটেনি। কেউ ঘটিয়েছে। কেউ তা ঘটানোর আদেশ দিয়েছে। তাই ওই ব্যক্তিরা যেই হোক না কেন তাদের খুঁজে বের করে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সরকারের দায়িত্ব।
প্রশ্ন : অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে আপনার অনেক মন্তব্য সমালোচিত হয়েছে। অনেকে একে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো হিসেবে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মজিনা : গণতন্ত্রে সবারই কথা বলার অধিকার আছে। আপনারা জানেন, এটি যথার্থ। তবে বাস্তবতা এমন নয়। আমি নিঃসন্দেহে কারো বিষয়ে নাক গলাচ্ছি না। বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। অনেক সময় বাংলাদেশিরা তা অনুধাবন করে না। অনেক সময় বাংলাদেশিরা ভুলে যায় যে, এটি বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। অনেক সময় বাংলাদেশিরা মনে রাখে না যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম অথবা তাদের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত স্থানে, যা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। এই অঞ্চলে তারা পারস্পরিক সম্পৃক্ত।
বাংলাদেশিরা অনেক সময় সহিংস চরমপন্থার বিকল্প ভুলে যায়। আমি কখনো এসব ভুলি না। বাংলাদেশ আমেরিকার কাছে, দক্ষিণ এশিয়ার কাছে, সারা বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব শান্তিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ। সাত থেকে আট হাজার নারী ও পুরুষ শান্তিরক্ষী শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করছে।
বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সাফল্য, স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি- এসব কিছু বিশ্বের বিষয়। এসব বিষয়কে যুক্তরাষ্ট্রসহ বাংলাদেশের অনেক বন্ধু গুরুত্ব দেয় ও সহযোগিতা করে।
আমরা সহযোগী হতে চেষ্টা করি। কে কী করছে তা দেখার জন্য আমি নিজে সফর করি। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা- সবাই সব সময় আমার সঙ্গে আছে। আমি কোনো গোপন বৈঠক করি না। এনএসআই, ডিজিএফআই- সবাই আমার সঙ্গে বসছে। এর মধ্যে গোপন কিছু নেই। গণমাধ্যম সর্বত্র আছে। আমি যা করি তাই একজন রাষ্ট্রদূতের করা উচিত। তবে এটি মোটেও সহজ নয়।
আমি জানি না, আপনারা ৬৪টি জেলার প্রতিটিতে গেছেন কি না। তবে এটি সহজ নয়। এটি বড় দেশ। রাষ্ট্রদূত কাদেরের (যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের) সঙ্গে আমার একটি প্রতিযোগিতা আছে। এটি তত ন্যায্য নয়। তবে তারটি আমার চেয়ে সহজ। তার আছে মাত্র ৫০টি মার্কিন অঙ্গরাজ্য। আমার আছে ৬৪টি জেলা। আমি মনে করি, আমি তাঁর চেয়ে এগিয়ে। তবে রাষ্ট্রদূতদের যা করা উচিত তিনি (আকরামুল কাদের) তাই করছেন। তিনি সব সময় বাইরে যাচ্ছেন, কথা বলছেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাই। গতকাল আমি মুন্সীগঞ্জে ছিলাম। ইদ্রাকপুর দুর্গের কথা কে জানে? বাবা আদম মসজিদের কথা কে জানে? ১৪৮৩ সালে এটি নির্মাণ করা হয়েছে, যা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারেরও ৯ বছর আগে। আমি কিছুই জানি না! টঙ্গিবাড়ী গিয়ে আমি হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়েছি। ঢাকায় বসে আপনারা এসব কিভাবে জানবেন? তাই আমি ঢাকার বাইরে যাই। আর যেখানেই যাই সেখানেই আমি বিশ্বের সেরা মানুষদের সাক্ষাৎ পাই। আমি সত্যি বলছি। আমি মনে করি, বাংলাদেশিরা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।