কানেকটিভিটির নামে ভারতকে ট্রানজিট

0
148
Print Friendly, PDF & Email

‘কানেকটিভিটি’র (সংযোগ) নামে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিষয়টি আবারো আলোচনায় নিয়ে আসা হচ্ছে। তবে সরকারের কাছে ‘ট্রানজিট’ বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। তাই বলার চেষ্টা হচ্ছে, ট্রানজিট নয়, বাড়ানো হবে কানেকটিভিটি বা সংযোগ। আর ভারতকে যদি তার ‘সেভেন সিস্টার্স’এ যাওয়ার জন্য ট্রানজিট না দেয়া হয় তবে তারা এ রাজ্যে পৌঁছানোর জন্য বিকল্প পথ ঠিকই করে নেবে।
ট্রানজিটের প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য ভারতের সাথে সংযোগ উন্নয়নের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এ জন্য সড়ক, রেল ও নৌপথ উন্নয়ন করা হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য নেয়া হয়েছে একগুচ্ছ পরিকল্পনা। তারই পদক্ষেপ হিসেবে দ্রুত গঠন করা হচ্ছে সচিবপর্যায়ের একটি ওয়ার্কিং কমিটি। তারা খতিয়ে দেখবে এই পরিকল্পনাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না। ভারতের সাথে কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য কমিটি সুপারিশও করবে। মূলত ভারতকে সামনে রেখে কানেকটিভিটি করা হলেও এর সাথে নেপাল ও ভুটানকে সংযুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ট্রানজিট বা করিডোর যা-ই বলি না কেন, তার জন্য আমাদের ‘মাইন্ডসেট’ ঠিক করতে হবে। আমরা যদি আমাদের দরজা বন্ধ করে দেই, তারা অন্য জায়গা দিয়ে দরজা করে নেবে।
ভারতের সাথে কানেকটিভিটি বৃদ্ধির জন্য গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আয়োজন করা হয় একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভার। ‘বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বাধাগুলো দূরীকরণ’ শীর্ষক এ বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী ছাড়াও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী, রেলপথমন্ত্রী মজিবুল হকসহ সংশ্লিষ্ট সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ও ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আহমেদ তারেক করিম।
সভার কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের পঞ্চগড় এবং পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং সড়কপথে যুক্ত। ‘এলসিএস’ দিয়ে নেপাল এবং ভারত থেকে পণ্য আমদানি-রফতানি হয় কিন্তু এখানে কোনো ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট নেই। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দ্রুত এখানে চেকপোস্ট স্থাপন করা হবে। বুড়িমারী-চেংড়াবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভুটান থেকে পণ্য আমদানি-রফতানি করা হয়। বাংলাদেশের লালমনিরহাট এবং পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ির সাথে সড়কযোগাযোগ ভালো। বাংলাদেশের স্থলবন্দরের অবকাঠামোও ভালো। কিন্তু ভারতীয় বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ এখনো শুরু হয়নি। তা ছাড়া ভারতের বন্দরে ‘ফিটোসেনিটারি অফিস’ পদায়ন হয়নি। তাই ভারতের অংশের অবকাঠামো ও অফিস স্থাপন করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতকে অনুরোধ করা হবে।
কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য নাকুগাঁও-ঢালু স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে স্থলবন্দর থেকে ভারতের তোরা শহর এবং গৌহাটির সাথে সড়কযোগাযোগ ভালো। কিন্তু বাংলাদেশের শেরপুর জেলা শহরের সড়কযোগাযোগ তেমন ভালো নয়। বাংলাদেশের বন্দরের কাজ প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে তা শুরুই করা হয়নি। এ বিষয়ে ভারতকে অনুরোধ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একইভাবে তামাবিল-ডাউকি স্থলবন্দর দিয়ে ভুটানের সাথে আমদানি-রফতানি করা হয়। তামাবিলের সাথে সিলেটের সড়কযোগাযোগ ভালো হলেও ভারতের ডাউকি থেকে শিলংয়ের দিকে ২৫ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা অত্যন্ত সরু। এ বিষয়টি উন্নয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বৈঠকে কানেকটিভিটি বাড়ানোর বিষয়ে আরো যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ আখাউড়া-আগরতলা রেল লিঙ্কের কাজ দ্রুত শেষ করা। আগরতলা-রামগড় রেলযোগাযোগের জন্য যৌথ আলোচনা শুরু করা, ভারতের ফুলবাড়িতে বিদ্যমান রেলপথের সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করা। দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে গত ২০১০ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীপর্যায়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সেগুলো কার্যকর করা। রোহনপুর-সিনবাদ ও রাধিকারপুর-বিরল রেল লিঙ্ক কার্যকর করার বিষয়টি নিষ্পত্তি করা। বাংলাদেশ-ভারত নৌপ্রটোকলে আসাম ও মেঘালয় এবং বাংলাদেশের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদীতে যাচাই-বাছাইপূর্বক আরো পোর্ট-অব-কল স্থাপন ও সংযোজন করা। দ্রুত ঢাকা-গৌহাটি বিমান যোগাযোগ চালু। সীমান্ত হাট স্থাপনে ভারতের প্রস্তাবগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা। আসন্ন গৌহাটি মেলায় অংশ নেয়া। গৌহাটি ও চেন্নাইয়ে বাংলাদেশের উপহাইকমিশন ও আগরতলা ভিসা অফিসকে সহ-হাইকমিশনে রূপান্তর করা, কোস্টাল শিপিং চালু এবং নয়াদিল্লি মিশনের কমার্শিয়াল উইংয়ে জনবল বাড়ানো।
জানা গেছে, মঙ্গলবারের বৈঠকে, ব্যবসায়-বাণিজ্যের স্বার্থে ভারতের কানেকটিভিটি বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কানেকটিভিটি না থাকলে কোনো বাণিজ্য থাকবে না। সেভেন সিস্টারসকে যাওয়ার জন্য ভারতে বাংলাদেশ ট্রানজিট বা করিডোর দেয়নি। কিন্তু ভারত ঠিকই বিকল্প পথে মিয়ানমারের সিতাও দিয়ে ওই সাত রাজ্যে পণ্য রফতানি করছে। এ জন্য ভারত সিতাও বন্দর উন্নয়ন করে দিয়েছে। তবে তাতে তাদের পণ্য পরিবহনব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের বেশির ভাগ পণ্য ভারত থেকে আনা হয়। এই পণ্য যদি চীন থেকে আনা হতো তবে তাতে ব্যয় হতো অনেক বেশি। তাই আমদানিকৃত পণ্যের দাম কমানোর জন্যই ভারতের সাথে কানেকটিভিটি বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র জানায়, বৈঠকে অভিযোগ করা হয়, রফতানি নিষিদ্ধ থাকাও সত্ত্বেও আখাউড়া দিয়ে ভারতে প্রচুর ইট চলে যাচ্ছে। অবিলম্বে ইট পাচার বন্ধর করতে হবে। এ পর্যায়ে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, বৈধভাবে ইট রফতানির কোনো সুযোগ নেই। দুই বছর আগে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একজন বক্তা বলেন, কানেকটিভিটি বিষয়ে ভারতের উদার হতে হবে। এখানে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের অনেক ভেতরে ঢুকতে পারছে। কিন্তু বাংলাদেশী ট্রাককে নো ম্যান্স ল্যান্ডে আটকে দেয়া হচ্ছে। এ সময় এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, এখন বাংলাদেশের ট্রাককে বেনপোল দিয়ে ২০০ গজ ভারতের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বিশ্বায়নের যুগে আমাদের আরো উদার হতে হবে। মনের দরজা খুলে দিতে হবে।
ভারতের সাথে ট্রানজিট বা কানেকটিভিটির বিষয়ে বলা হয়, স্থলবন্দরের বাংলাদেশ অংশে সড়ক যোগাযোগ ভালো। কিন্তু ভারতের অংশে তা ভালো নয় । নৌপথে কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য নৌপথ খনন করা হচ্ছে বলেও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়।
মঙ্গলবারের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘ব্যবসায়-বাণিজ্য বাড়াতে হলে রিজিওনাল কানেকটিভিটি ও কো-অপারেশন বাড়াতে হবে। এটা নাম্বার ওয়ান ইম্পরটেন্ট। করিডোর বলেন বা ট্রানজিট বলেন দ্যাট ইজ নট ইম্পরটেন্ট। ইম্পরটেন্ট হচ্ছে কানেকটিভিটি। এক দেশের সাথে অন্য দেশের সংযোগ স্থাপন করা।’
ভারতের সাথে কানেকটিভিটি বাড়াতে করিডোর বা ট্রানজিট প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের এক ধরনের মাইন্ডসেট আছে। আমরা যদি আমাদের দরজা বন্ধ করে দেই, অন্য জায়গা দিয়ে দরজা করে নেবে। কেউ কারো জন্য বসে থাকবে না। এর মানে এই নয় যে, বিনা স্বার্থে আমরা দরজা খুলে দেবো। এটা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়।’
মন্ত্রী বলেন, ‘ ভারত থেকে যেকোনো পণ্য আমদানি আমাদের জন্য সহজ ও সস্তা। এ কারণেও ভারতের সাথে আমাদের কানেকটিভিটি বাড়ানো দরকার। অন্যান্য দেশও প্রতিবেশী দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে থাকে।’ প্রসঙ্গক্রমে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমান যুগ হচ্ছে গ্লোবাইলাইজেশন (বিশ্বায়ন) ও লিবারালাইজেশন (উদারীকরণ) ও মুক্ত অর্থনীতির যুগ। ভারত, চীন ও মিয়ানমার কেউ বসে নেই। তারা কানেকটিভিটি বাড়িয়ে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে তাদের পণ্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা যদি ভারতে করিডোর বা ট্রানজিট না দেই তাহলে তারা কিভাবে তাদের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে পণ্য আনা-নেয়া করবে তারা সে ব্যবস্থা করছে। এমতাবস্থায় সেটা মোকাবেলা করে আমাদের রফতানি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্য আমাদের করণীয় বিষয়েও মনস্থির করতে হবে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বৈঠকে তামাক ও অ্যালকোহল ছাড়া ভারতে বাংলাদেশী পণ্য শুল্কমুক্ত রফতানির যে সুযোগ পাওয়া গেছে এটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে ও বাধাগুলো দূর করা, ভারতে পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়ন করা এবং সেখানে কাস্টমস অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট স্থাপন, কোস্টাল শিপিং চালু ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং স্থলবন্দর-রেল ও নৌযোগাযোগ উন্নয়নে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে একই সাথে ভারতের পক্ষ থেকেও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারত, চীন ও থাইল্যান্ড নিজেদের মধ্যে কানেকটিভিটি বাড়াচ্ছে উল্লেখ করে সরকারের বর্ষীয়ান এই মন্ত্রী বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আমাদেরও বাণিজ্য-স্বার্থ রয়েছে। তিনি বলেন, এ ছাড়া রফতানিপণ্য বহুমুখীকরণ ও বাজার সম্প্রসারণে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ঢাকা-গৌহাটি বিমানযোগাযোগ আগামী জুনের মধ্যেই চালু করা হবে।

শেয়ার করুন