শক্তিশালী কেন্দ্র চায় তৃণমূল

0
103
Print Friendly, PDF & Email

সবার আগে ঢাকায় দলের অবস্থান মজবুত দেখতে চান বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর কমিটির দিকে নজর তাদের। বিএনপির ‘প্রাণ’ হিসেবে খ্যাত নগর কমিটির সাংগঠনিক ভিত মজবুত হলে অক্ষুণ্ন থাকবে আন্দোলন-সংগ্রামে দলের শক্তিশালী অবস্থান_ দলের কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী সবাই এটা একবাক্যে মেনে নিচ্ছেন। এরপরও থমকে আছে ঢাকা মহানগর কমিটির পুনর্গঠন। এ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশনাও উপেক্ষিত। প্রায় মাসখানেক ধরে তোড়জোড় চললেও এখন তা থমকে গেছে। এতে ক্ষুব্ধ দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। আগামীতে আন্দোলন-সংগ্রামের উপযোগী একটি সুশৃঙ্খল-সুসংগঠিত কমিটি দেখতে চান তারা। বিএনপির দুর্দিনে রাজপথে থাকা নেতারা মনে করেন, শুধু রাজধানীভিত্তিক কর্মসূচি সফলভাবে পালন করতে না পারার কারণেই দৃশ্যমান হয়নি সরকারবিরোধী আন্দালনের সফলতা। এর দায়ভার কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাসহ পুরো নগর কমিটির। অতিদ্রুত কেন্দ্রসহ নগর কমিটি পুনর্গঠন করা না হলে আবারও মুখ থুবড়ে পড়বে আন্দোলন-সংগ্রাম। সব জেলা এবং তৃণমূল থেকে অবিলম্বে শক্তিশালী ঢাকা মহানগর কমিটি গঠন এবং কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের দাবি জানানো হচ্ছে। শক্তিশালী ঢাকা কমিটি হলে কেন্দ্রও শক্তিশালী হবে। আর এতে আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার সম্ভব বলে তৃণমূল মনে করে। এদিকে সাংগঠনিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে বিভিন্ন জেলায় সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নেননি মাঠ নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি_ সারা দেশে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্বের কাছাকাছি পেঁৗছে দিয়েছিলেন মাঠ নেতাকর্মীরা। দৃশ্যমান সফলতা আসেনি ঢাকার নেতাদের জন্য। এজন্য দায়ী নগর কমিটি। এর দায়ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া সমীচীন নয়। সবার আগে সাংগঠনিকভাবে ঢাকাকে শক্তিশালী করতে হবে। এরপর নতুন আন্দোলনের ভাবনা। তৃণমূলের এমন মনোভাব বুঝতে পেরে এবং মাঠনেতাদের তোপের মুখে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই ওই সফর বাতিল করা হয়। এরপর ঢাকা মহানগর কমিটি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলন সফল না হওয়ার কারণ হিসেবে নেতাদের অযোগ্যতা ও আপসকামিতাকে দায়ী করেছেন সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির এক নেতা। নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে ওই নেতা বলেন, সারা দেশে বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সবক’টি কমিটি আন্দোলন-সংগামে সক্রিয় ছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ঢাকা মহানগর বিএনপি। রাজধানী ঢাকাকে সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্নও করা হয়েছিল। ঠিক তখনই ঢাকার নেতারা রাজপথে না বেরিয়ে নিরাপদে গা-ঢাকা দেন। ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের রাজপথে নামার আহক্ষান জানালেও কেউ নামেননি। এমনকি ওই সময় চেয়ারপারসনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন অনেকে। ঢাকার নেতাদের ব্যর্থতা ও আপসকামিতায় আন্দোলন আর আলোর মুখ দেখতে পারেনি। চূড়ান্ত সফলতা ঘরে তোলা সম্ভব হয়নি। পরিণতিতে প্রাণ দিতে হয়েছে রাজপথে থাকা নেতাকর্মীদের। নির্যাতন-নিপীড়নসহ অসংখ্য মামলা ঘাড়ে নিয়ে এখনও তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন ঢাকার সেই সুবিধাবাদী নেতারা। এ অবস্থায় সবার আগে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজিয়ে আন্দোলনমুখী করে তুলতে হবে বলে মত দেন ওই নেতা।

এদিকে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা থমকে গেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি গুলশানের কার্যালয়ে নগর নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকে ঢাকা মহানগরীতে বিগত আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। আন্দোলনে রাজপথে না থাকায় চেয়ারপারসনের তোপের মুখে পড়েন নগর নেতারা। শীর্ষ নেতাদের কাছে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার কথা জানতে চান খালেদা জিয়া। জবাবে ঢাকার আন্দোলন প্রসঙ্গে নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নেতারা জানান, সাধ্যমতো চেষ্টা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মারমুখী আচরণের কারণে আন্দোলন যথাযথ ফলপ্রসূ হয়নি। তাদের কথায় সন্তুষ্ট হননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি পুনর্গঠনের জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে শিগগিরই একটি ‘বিশেষ কমিটি’ করা হবে। কমিটির কাজ হবে সম্মেলনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরের প্রতিটি থানা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি ঘোষণা করা। ত্যাগী নেতাদের অগ্রাধিকার দিয়ে এক মাসের মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম উপযোগী ঢাকা মহানগর কমিটি গঠনের জন্য বিশেষ ওই কমিটি গঠনের কথা ছিল। কিন্তু ২৩ দিনেও ‘বিশেষ কমিটি’ গঠন করা সম্ভব হয়নি। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান নগর কমিটির আহক্ষায়ক সাদেক হোসেন খোকা। মুক্তির পর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন নগর কমিটির এই শীর্ষ নেতা। চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কমিটি পুনর্গঠনের বিষয়টি থমকে গেছে বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে।

নাম প্রকাশে রাজি নন বিএনপির তৃণমূল এক নেতা বলেন, গত বছর ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অবস্থানরত হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মহানগরের নেতাদের আহক্ষান জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু খালেদা জিয়ার ওই নির্দেশ পালন করেননি মহানগরের কোনো নেতা। তারা সক্রিয় থেকে চেয়ারপারসনের নির্দেশ পালন করলে আজ দলের এমন অবস্থা হতো না। ওইদিন সন্ধ্যায় হেফাজত কর্মীদের খাবার পানির প্রয়োজন দেখা দিলে তাও এড়িয়ে গেছেন অনেকে। সটকে পড়েছিলেন একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে। এরপর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে খালেদা জিয়ার ঘোষিত ২৯ ডিসেম্বরের মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিও তাদের নিষ্ক্রিয়তায় ভ-ুল হয়। ওই কর্মসূচি সফল করার জন্য ঢাকা মহানগরকে আটটি জোনে ভাগ করে আট নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশও পালন করেননি স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ মহানগরের অনেক নেতা। ওইদিন খালেদা জিয়া গুলশানের বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাকে বাসভবনের গেটে আটকে দেয়। সেসময় কোনো নেতাকর্মীকে খালেদা জিয়ার বাসার আশপাশেও দেখা যায়নি। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে লুকোচুরি খেলেছেন বিএনপির প্রাণখ্যাত মহানগর কমিটির অধিকাংশ নেতা।

আন্দোলনে ব্যর্থতা প্রসঙ্গে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালাম বলেন, আমি এটাকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে চাই না। রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনে আমরা শতভাগ সফল। ৫ ভাগেরও কম ভোটার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। সরকার আমাদের রাস্তায় নামতে দিচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি আছে, মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, সারা দেশে তুমুল আন্দোলন হলেও সরকার তাদের সব শক্তি দিয়ে ঢাকা শহরকে আটকে রেখেছিল। প্রশাসনও তাদের পক্ষে কাজ করেছে। দেখলেই গুলি করা হয়েছে। ওরা জানে যে ঢাকায় আন্দোলন হলেই সরকারের পতন হবে। এ অবস্থায় রাজপথে কী করে আন্দোলন করা সম্ভব?

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারের দমন-পীড়নের কারণে দলের নেতারা রাস্তায় নামতে পারেননি_ এটা যেমন সত্য, তেমনি অনেক নেতার সদিচ্ছারও অভাব ছিল। তিনি বলেন, বিএনপিসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন বা পরিবর্তন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। ম্যাডাম চাইলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেন।

এদিকে, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে মতবিনিময় করছেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২২ জানুয়ারি সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে এ মতবিনিময় সভা শুরু হয়। এরপর চিকিৎসক সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), আইনজীবী প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক নেতা, সর্বশেষ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকৌশলী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন খালেদা জিয়া। তবে দল পুনর্গঠন না করে এ মতবিনিময়ের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছেন না তৃণমূল নেতাকর্মীরা। আলাপকালে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারা। এ প্রসঙ্গে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী, বরিশাল, রাজশাহী ও সাতক্ষীরা বিএনপির অনেক নেতা জানান, নির্বাচন প্রতিহত করতে না পেরে আন্দোলন থেকে সরে এসেছে বিএনপি। তারা বলেন, আমরা আন্দোলনকে এগিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ঢাকার নেতাকর্মীরা আন্দোলনের সফলতা নষ্ট করেছেন। এজন্য তারা নিজেরাই দায়ী। চেয়ারপারসন দল গুছিয়ে আবারও আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলছেন। এটা করতে হলে সবার আগে সাংগঠনিকভাবে ঢাকাকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। এ নিয়ে মাঠকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।

শেয়ার করুন