সেক্ষেত্রে চলতি মাস থেকেই সাড়ে ১ কোটি ৪২ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুতের জন্য বাড়তি দাম দিতে হতে পারে। আর এর প্রভাব পড়বে বাজার দর থেকে বিনিয়োগ- সব ক্ষেত্রেই।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কার্যালয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রস্তাবের ওপর শুনানি শুরু হয়। এরপর বেলা পৌন ৩টায় হয় পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ওজোপাডিকো) প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি।
শুনানিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিতরণ সংস্থা পিডিবি গড়ে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ওজোপাডিকো গড়ে ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। এসব প্রস্তাব পর্যালোচনা করে বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটি যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে মত মত দেয়।
বর্তমানে এ দুটি কোম্পানি বিভিন্ন স্ল্যাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে ২ টাকা ৫১ পয়সা থেকে ১১ টাকা ৮৫ পয়সা পর্যন্ত দাম রাখছে।
বুধবার ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কর্তৃপক্ষ (ডেসকো) এবং বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) প্রস্তাবিত দামের ওপর গণশুনানি হবে। প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দেয়া হবে দাম বাড়ানোর ঘোষণা।
বিইআরসির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সাংবাদিককে বলেন, “দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিতে আমরা দেরি করব না। ১০ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। এবার গড়ে ৬ থেকে ১০ শতাংশ দাম বাড়তে পারে।”
সর্বশেষ ২০১২ সালে সেপ্টেম্বরে খুচরা বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ এবং পাইকারির দাম ১৭ শতাংশ বাড়ানো হয়।
এদিকে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে একটি সংগঠন সকাল থেকেই বিইআরসি কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভ দেখায়। শুনানিতে অংশ নেয়া ভোক্তা অধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিও এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেন।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই ভবনের সামনে শুরু হয় গণসংহতি আন্দোলনের ‘গণ অবস্থান’ কর্মসূচি। এর আগে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ মিছিল কারওয়ানবাজার এলাকা প্রদক্ষিণ করেন সংগঠনের কর্মীরা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা শামসুল আলম শুনানিতে বলেন, “অতীতে বিভিন্ন শুনানিতে বলা হয়েছে, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেশি দামে যে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে তা ২০১৪ সালের পর আর লাগবে না। বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাখা হচ্ছে।
“বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে আজ থেকে আমাদের চেষ্টা হোক বিদ্যুতের দাম কমানোর।”
নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শামসুল আলম প্রশ্ন করেন, “এ মূল্যবৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কিছুর মূল্য বাড়বে। তার অভিঘাত থেকে উৎপাদন ও জীবন ব্যবস্থাকে সুরক্ষার বিষয়টি সবার আগে হিসাব নিকাশ ও পরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে। তা কি এসেছে?”
বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখতও বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে তার প্রভাব বাজার দর থেকে বিনিয়োগ- সব ক্ষেত্রেই পড়বে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেক তিনি বলেন, “বিদ্যুতের দাম বাড়লে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, ফলে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে বিনিয়োগেও ধাক্কা লাগবে।”
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে বড় অংকের ভর্তুকি সামাল দিতেই সরকার দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
অপেক্ষাকৃত বেশি মূল্যের তেলভিত্তিক ভাড়া বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা বাড়ার পর গত পাঁচ বছরে খুচরা ও পাইকারি মিলিয়ে ১১ দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। তারপরও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
সর্বশেষ ২০১২ সালে ডিসেম্বরে খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর শুনানি হলেও জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। তবে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর সম্প্রতি নতুন করে দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি সংসদে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেন।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমাদের আশেপাশের দেশে বা অন্যান্য দেশে দেখেন- কত টাকায় বিদ্যুৎ কেনে? উৎপাদন খরচ তো দিতে হবে। ব্যবহার করবেন আর দাম দেবেন না?”
সরকার নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে সিপিবি ও বাসদ এবং গণসংহতি আন্দোলনসহ বাম সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
সংগঠনগুলোর অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় খাতের বন্ধ হওয়া বিদ্যুৎ কারখানা মেরামত, নবায়ন ও সম্প্রসারণ না করে তেলভিত্তিক কুইক রেন্টালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। আর এই ব্যয়ের বোঝা সরকার টানতে না পেরে জনগণের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে।
বুধবার ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা বিদ্যুত্ সরবরাহ কর্তৃপক্ষ (ডেসকো) এবং বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) প্রস্তাবিত দামের ওপর গণশুনানি হবে বিইআরসি কার্যালয়ে।